অন্তত পঁচিশ বছর আগের ঘটনা।
এরকম এক কোরবানির ঈদে গরু কিনলাম আমরা! গরুর মালিকের বাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে তিন/চার গ্রাম পরে!
বাজারে গরু দরদাম হয়ে যাওয়ার পর, হঠাৎ করে গরুর মালিক প্রস্তাব দিলো, 'ঈদেরতো এখনো ৪/৫ দিন বাকি। আপনি এক্ষুণি গরু নিয়ে গিয়ে কি করবেন? তারচেয়ে গরুটা আমার বাড়িতেই থাক। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো সারা বছর ধরে গরুটারে বড় করেছে, আরো দুইটা দিন ওদের কাছে থাকলে ওরা খুশি হবে।'
আমার বাবা আনন্দেই প্রস্তাবটাটা মেনে নিলেন। ভাবলেন, এতো তাড়াতাড়ি বাড়িতে গরু নিয়ে যাওয়াতো ঝামেলাই। পাহারা দিয়া রাখা, খাওয়ানো, তারচেয়ে ওর বাড়িতেই থাকুক। ঈদের আগের দিন নিয়ে আসলেই হবে।
এদিকে আমাদের আর তর সয় না। সবার গরু আছে, আমাদের নাই! আমরা এইজনকে ধরি, ওইজনকে অনুরোধ করি। গরু নিয়ে আসতে কেউ রাজি না। শেষে বড় ভাই রাজি হলো! আমরা ধিন তা করে নাচতে নাচতে সেই বাড়িতে গেলাম।
সেই বাড়ি থেকে গরু নিয়ে আসতে গিয়ে তো মহা ঝামেলা। এ এইদিকে কান্নাকাটি করছে, ওদিকে আরেকজন গরুর রশি কোনো মতেই ছাড়বে না। গরু আনা যাবে না। এক শিশু মাটিতে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি শুরু করলো। সে গরুর সাথে যাবে! ঘরের দরজায় বসে বুড়ো মতো এক নারী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে! সেই কান্না দেখে আমার এক ছোট ভাইও কান্নাকাটি শুরু করে দিলো!
গরু নিয়ে আসা হলো। বাড়িতে আসার পরে সবার আনন্দ দেখে আমরা সেই বাড়িটার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। আমরা সবাই এই ভেবে উত্তেজিত যে, 'কাল সকালে গরু জবাই হবে!'
সকালে ঈদের নামাজ পরে এসে দেখি, গরুর সেই মালিক আমাদের বাড়ি এসে হাজির! বাড়ির পাশের পুকুরে গরুকে গোসল দিচ্ছে, গলায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! গরুটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো সেই আদর নিচ্ছে!
বাবার হাতে গরুর রশিটা তুলে দিয়ে বললো, 'গরুটা গত ছয় বছর আমার বাড়িতে ছিলো। যখন নিয়া আসছিলাম ছোট্ট একটা বকনা ছিলো। জবাই করার সময় খুব বেশি কষ্ট দিয়েন না।' এরপর চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।
ছোটবেলার এই ঘটনাটা প্রতি কোরবানির ঈদ এলেই আমার মনে পড়ে। তার সেই শুকনো মুখ, উঠান গড়িয়ে গড়িয়ে ছোট শিশুর কান্নার মুখ, অথবা পুকুরের জলে দাঁড়িয়ে গরুর পিঠে-মাথায় হাত বুলানো।
কোরবানির ঈদ মানে এরকম অজস্র আত্মত্যাগের গল্প, যারা সারা বছর ধরে একটু একটু করে তার সংসারের অবশ্যম্ভাবী অংশ হিসাবে একটা গরু কিংবা দুইটা ছাগল লালন-পালন করে। সে জানে যে, ঈদ এলেই সেটা বিক্রি করবে, দুটো টাকা বেশি পাবে।
কিন্তু ঈদ এলে, সেই জন্তুটা বিক্রি করে দেয়ার পর, সেই গৃহ মালিক, সেই গৃহিনী অথবা পরিবারের ছোট শিশুরা চোখ মুছতে থাকে! তাদের মনে হয়, পরিবারের কেউ একজন তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে!
গোয়াল ঘরের কাছাকাছি গেলে তাদের বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। ভুলেও গোয়াল ঘরের দিকে তাকায় না।
এই শহুরে, আড়ম্বরপূর্ণ জীবনে, সেই ত্যাগ আর অনুভূতির কাছাকাছিও কি আমরা পৌঁছাতে পারি? আমাদের কাছে কোরবানি মানে কত টাকার গরু কেনা হলো, কয়টা গরু কে জবাই দিল অথবা কত কেজি মাংস হলো!
আমাদের কাছে যা মাংস, আরেকজনের কাছে সেটা শুধু দীর্ঘ বছরগুলোতে একটু একটু করে গড়ে তোলা ভালোবাসার কোরবানি!
আমাদের সবার চোখের জল সমুদ্রে গিয়ে মিশুক।
চোখের পোড়ানি বন্ধ হোক আর এই কোরবানির ত্যাগের মহীমায় উজ্জ্বল হোক জীবন!

~Raju Norul