ঝিলিমিলি

মির্জা সাহেবের দ্বিতল বাড়ির উপর-তলার প্রকোষ্ঠ। মির্জা সাহেবের ষোড়শী মেয়ে ফিরোজা রোগশয্যায় শায়িতা। সব জানাল??

কাউকে ভালোবাসেননি। নইলে মানুষ কখনো এমন নীরস আর নিষ্ঠুর হয়!

হালিমা :

তুই কি থামবি নে ফিরোজা? লক্ষ্মী মা আমার, কেন মন খারাপ করছ এত, বল তো! আজ যে তোকে চুপ করে থাকতে বলে গেছে ডাক্তার।

ফিরোজা :

আচ্ছা মা, কাল থেকে ওই পুব-দিককার জানলাটা খুলবে তো, তখন তো আর আব্বা বকবেন না?

হালিমা :

(শিহরিয়া উঠিলেন। কান্নায় তাঁহার গলা ভাঙিয়া আসিল।) ও কী কথা বলছিস ফিরোজ?

ফিরোজা :

কাল আর ও-জানলা খুলতে বলব না মা! (বালিশে মুখ লুকাইল।)

হালিমা :

(হঠাৎ পাথরের মতো স্থির হইয়া গেলেন। কণ্ঠ তাঁহার অশ্রুবিকৃত হইয়া উঠিল।) বুঝেছি রে হতভাগি, সব বুঝেছি। তুই আমাদের বড়ো শাস্তি দিয়ে যাবি। … মা, এই আমি খুলে দিচ্ছি পুব-জানলা, তুই অত অধীর হসনে। (পুব-জানালা খুলিয়া দিতেই সম্মুখের বাড়ির মৃদু-আলোকিত বাতায়ন দেখা গেল। বাতায়নপথে কে যেন ছটফট করিয়া ফিরিতেছে। দূর হইতে তাহাকে ছায়ামূর্তির মতো দেখাইতেছিল। ছায়ামূর্তি নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মনে হইল যেন এই বাতায়ন-পানেই সে অচঞ্চল দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে। হালিমা আড়ালে চক্ষু মুছিলেন।)

ফিরোজা :

(ব্যাকুল দৃষ্টিতে বাতায়ন-পথে তাকাইয়া রহিল।) মা, বাঁশি বাজছে না? উঁহুঁ কে যেন কাঁদছে! (অস্থির হইয়া) বাইরে কে কাঁদে মা? মা, মা, শোনো!

হালিমা :

কই মা, কিছু না। ও বৃষ্টির ঝরঝরানি। … হুঁ … না …হাবিব বুঝি গান করছে এসরাজ বাজিয়ে।

ফিরোজা :

আহ! বৃষ্টিটা যদি থামত, গানটা শুনতে পেতাম … বৃষ্টি থেমে আসছে – না মা?

হালিমা :

হাঁ মা, বৃষ্টিটা ধরে এল।

ফিরোজা :

মা – মা! এইবার শুনতে পাচ্ছি গান। আহ! একটু শব্দ না হয় যেন। মা তুমি চুপ করে শোনো। (বাতায়ন হইতে গান ভাসিয়া আসিতেছিল।)

 

গান

 

হৃদয় যত নিষেধ হানে নয়ন ততই কাঁদে।

দূরে যত পলাতে চাই, নিকট ততই বাঁধে॥

স্বপন-শেষে বিদায়-বেলায়

অলক কাহার জড়ায় গো পায়,

বিধুর কপোল স্মরণ আনায়

ভোরের করুণ চাঁদে॥

বাহির আমার পিছল হল কাহার চোখের জলে।

স্মরণ ততই বারণ জানায় চরণ যত চলে।

পার হতে চাই মরণ-নদী

দাঁড়ায় কে গো দুয়ার রোধি,

আমায় – ওগো বে-দরদি –

ফেলিলে কোন্ ফাঁদে॥

 

[গান শেষ হইলে বাতায়নের আলো উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। সেই আলোকে এক প্রিয়দর্শন তরুণের মূর্তি স্পষ্ট হইয়া দেখা দিল। সে স্থির দৃষ্টিতে এই দিকেই তাকাইয়া আছে।]

 

ফিরোজা :

মা – মা-মণি! ঘরের বাতিটা খুব উজ্জ্বল করে দাও। যেন আমায় খুব ভালো করে দেখা যায় ও-বাড়ি হতে। (বাহিরে কাহার পদশব্দ শোনা গেল।)

হালিমা :

ওরে ফিরোজ! বন্ধ কর, বন্ধ কর, পুব-জানালা। তোর আব্বা আসছেন। (মির্জা সাহেব গৃহে প্রবেশ করিতেই একটা দমকা হাওয়ায় প্রদীপ নিবিয়া গেল। হালিমা আবার বাতি জ্বালাইলেন।)

মির্জা সাহেব :

আর জানলা বন্ধ করতে হবে না। আমি বহুক্ষণ থেকেই তোমাদের কীর্তি দেখছি। দেখ, আর যা-ই কর, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চেষ্টা, কোরোনা। (হালিমা নিরুত্তর) … আর ওই বাঁদর ছোঁড়াটাকেই বা কী বলি! এক গাছা কাঁচা বেত নিয়ে বেতিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত … (ক্রোধে বদ্ধমুষ্ঠি হইয়া দাঁত কড়মড় করিয়া উঠিলেন।) দিনরাত গান আর গান! বাঁশি আর এসরাজ! স্থিরচিত্তে একটু ‘কোরান তেলাওত’ করবার কী নামাজ পড়বার জো নেই। হতচ্ছাড়া পাজি কোথাকার! ওই বিশ্ব-বখাটে আবার বলে, পাশ করবে বি.এ.। ও তো ফেল করেই আছে। ওই রত্নের সঙ্গে দেব মেয়ের বিয়ে!

হালিমা :

দেখো, তোমার পায়ে পড়ি, আজ একটু আস্তে কথা কও, আজ ফিরোজা কেমন যেন করছে!

মির্জা সাহেব :

(পুব-দিককার জানালাটা বন্ধ করিতে করিতে) হুঁ। … তা এমন করে জানলা খুলে তাকিয়ে থাকলে যে-কোনো আইবুড়ো মেয়েরই অসুখ করে।…দেখ, তুমিই ফিরোজার মাথা খেলে। আর ওই বুড়ো বয়সেও তোমায় গান গাওয়া অভ্যেস গেল না। কী ভুলই করেছি স্কুলে-পড়া মেয়ে বিয়ে করে!

হালিমা :

সত্যি, এ ভুল না হলে দুইজনই বেঁচে যেতাম। আমি এ কথা-ভাবতেও পারিনে যে, কোনো কোনো গ্র্যাজুয়েট গোঁড়ামিতে কাঠ-মোল্লাকেও হার মানায়।

মির্জা সাহেব :

শরিয়তের বিধি-নিষেধ মানাকে তুমি গোঁড়ামি মনে কর, এ অভিযোগ তো বহুবার শুনেছি, হালিমা। আর কোনো নতুন কথা শোনাবার থাকে তো বলো।

হালিমা :

আছে। তোমার মতো শরিয়তের টিন-বাঁধানো হৃদয়ে তা কি লাগবে? …একটু আগে গানের খোঁটা দিচ্ছিলে। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ যে,আমি গান গাইতে পারি জেনেই তুমি আমায় বিবাহ করে কৃতার্থ হয়েছিলে!

মির্জা সাহেব :

ভুলিনি সেকথা। কিন্তু তখন জানতাম না যে তোমার গান শুধু চোখের জল, শুধু ব্যথা। কেন গান শরিয়তে নিষিদ্ধ, তা আমার চেয়ে কেউ বেশি বুঝবে না! শরিয়তে যিনি সংগীত নিষিদ্ধ করেছিলেন, তিনি জানতেন এর ব্যথা দেওয়ার পীড়া দেওয়ার শক্তি কত।

হালিমা :

আমি এও জানি, যিনি এই শরিয়তের স্রষ্টা, তিনি গান শুনে আনন্দও পেয়েছেন। যাক, তর্ক করবার স্থান এ নয়। মেয়েটাকে একটু শান্তিতে মরতে দেবে কি?

মির্জা সাহেব:

দেখ, জীবনে হয়তো শান্তি দিইনি তোমাদের। আমার বিশুষ্ক জীবনে তোমাদের জন্যে হাসির ফুল ফোটাতে পারিনি, শুধু কাঁটাই ফুটিয়েছি। কিন্তু মরণেও তোমাদের অশান্তি হানব, এত বড়ো গালি আমায় না-ই দিলে!


Md Nafiz

136 Blog Mesajları

Yorumlar