ঘোরের মধ্যেও বুঝতে পারা যাচ্ছে, দুজন মানুষ সঙ্গমে লিপ্ত। তাদের শীৎকার কানে আসছে উর্মির। বারবার বোঝার চেষ্টা করছে, সে যা শুনছে তা মনের ভুল নয়তো? এই বাড়িতে উর্মি আর সানি ছাড়া কেউই থাকে না। সানি এখন ওর পাশেই শুয়ে আছে, তাহলে কারা এখন সঙ্গমে লিপ্ত?....
একমাস হলো বিয়ে হয়েছে উর্মি আর সানির। আর এই একমাসেই উর্মির জীবন কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকেই সে মানসিক রোগে ভুগছে, অসময়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে, সারাদিন ক্লান্তি ভাব, কোনো কিছুই তার ভালো লাগে না, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এই একমাসে একবারও সানির সাথে কোনোরকম শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি তার। তবে সানি উর্মিকে ভীষণ আগলে রাখে, ভালোবাসে। বারবার বুঝিয়ে বলে, উর্মি সুস্থ হয়ে যাবে। সময়মতো ওষুধ খাইয়ে দেয় সে। উর্মির যত্নের কোনো ত্রুটি রাখতে চায় না সানি।
অনেকদিন পর অফিসে যায় উর্মি। অবশ্য সানি বারবার বারণ করেছিল। শেষে উর্মির জেদের কাছে হার মেনে সানি নিজেই তাকে অফিসে পৌঁছে দেয়। উর্মি অফিসে ঢোকার আগে সানি হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে। কতক্ষণ ধরে জড়িয়ে ছিল তা উর্মি জানে না, শুধু বুঝতে পারছিল, সানির মতো কেউ তাকে আজ পর্যন্ত ভালোবাসেনি, তাকে যেভাবেই হোক সুস্থ হতে হবে।
এইসবটাই ব্যালকনি থেকে দেখছিল ঋষি। রা গে অভিমানে তার চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো। নিজের কেবিনে গিয়ে খানিকটা সামলে নিয়ে, উর্মির সামনে গিয়ে, কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললো, এটা অফিস নাকি আড্ডার জায়গা? যখন খুশি আসবেন, না বলে ছুটি নেবেন.....
ঋষির কাছে এইরকম ব্যবহার কোনোদিন আশা করিনি উর্মি, তবে সবচেয়ে অবাকের বিষয়, ঋষি তাকে 'আপনি' দিয়ে কথা বলছে। উর্মির শরীর ভীষণ দুর্বল এই মুহুর্তে, কোনো কিছু বলার মতো অবস্থায় সে নেই, তাই অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো সে ঋষির দিকে।
ঋষি এর আগে কোনোদিনও এইরকম অবস্থায় দেখেনি, বড্ড ক্লান্ত লাগছে মেয়েটাকে, বোধহয় শরীর ভালো নেই, তবে বেশিক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না, আবার হয়তো মায়ায় জড়িয়ে যাবে। তাকে যে অনেক কঠোর হতে হবে।
উর্মি সব থেকে বেশি ভালোবাসে তার সৎ বোন সৌমিকে। উর্মির মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা যখন আবার বিয়ে করেন, তা কিছুতেই উর্মি মানতে পারেনি, তবে একবছর পর বোনকে পেয়ে তার কিছুটা হলেও ক ষ্ট লাঘব হয়েছিল। সৎ মাকে কোনোদিনও মা বলে ডাকেনি উর্মি, সে ভাবে কথাও হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে তার সৎ মা মালিনী দেবী যতটা সম্ভব উর্মিকে কাছে টানার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনোদিনই মনের দূরত্ব ঘুচেনি। তবে সৌমির প্রতি উর্মির এই ভালোবাসা দেখে মালিনী দেবী খুব খুশিই হয়েছিলেন।
সানির সাথে হঠাৎই বন্ধুত্ব হয়েছিল উর্মির, সে কথা শুধু জানতো সৌমি। তারপর মালিনী দেবী জানতে পারায়, একটু বাধা দিয়েছিলেন উর্মিকে। আর সেই জেদেই উর্মি সানিকে বিয়ে করার সিন্ধান্ত নেয়।
বিয়েটা এইরকম তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়াতে সব থেকে ক ষ্ট পেয়েছিল উর্মির অফিসের বস ঋষি।
ঋষি যে তার মনের কথাগুলো কোনোদিনই বলতে পারলো না উর্মিকে। আর উর্মিও কোনোদিন ঋষির না বলা কথাগুলো বুঝতে পারলো না। সবকিছুই যেন একটা ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দিল।
আজও হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল উর্মির। আজ অবশ্য সে কোনো সঙ্গমের শীৎকার শুনতে পায়নি, তবে নীচের রুম থেকে তার একটা প্রিয় গান শুনতে পাচ্ছে। পাশেই সানি শুয়ে আছে, তাহলে নীচে কে গান শুনছে? তবে উর্মি সানিকে বির'ক্ত করতে চায়না। সে নিজেই বেড থেকে নামলো, আজও সে একটা ঘোরের মধ্যে, বোধহয় ওষুধের জন্য। ডাক্তার যে তাকে বারবার রেস্টে থাকার কথা বলেছেন। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলো, হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ পেয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই পর্দার মতো কি যেন একটা এসে তাকে ঠে'লে দিল, আর উর্মিও গড়িয়ে পড়ে গেল সিঁড়ি থেকে।
উর্মির যখন বাবা মা'রা যান, তখন উর্মির ১৫ বছর বয়স। সৎ মায়ের কাছে বাধ্য হয়ে থাকতে হতো তাকে। এত বড় বাড়িতে ভীষণ একলা লাগতো তার। প্রিয় মানুষ বলতে, সৎ বোন সৌমিই ছিল একমাত্র।
সৌমিরও তার দিদির প্রতি ভালোবাসা ছিল অগাধ। হয়তো আজও আছে, তাই উর্মির এই অবস্থার কথা শুনে মেঘালয় থেকে ছুটে এসেছে কাজ ফেলে। উর্মির বিয়ের পর দিনই তাকে যেতে হয়েছিল মেঘালয়।
তখনও উর্মির জ্ঞান ফেরেনি, সৌমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আর অবাধ্য চোখের জল গড়িয়ে আসছে চোখ থেকে। উর্মির আর এক পাশে বসে আছে সানি, ঋষি কিছুটা দূরে আর উর্মির সৎ মা দেয়ালে ঠেস দিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রতিটা মানুষ এই সময় কি ভাবছে তা শুধু নিজেরাই জানেন। ঋষি অবাক হয়ে উর্মির মুখের দিকে চেয়ে আছে, কিছুতেই বুঝতে পারছে না, উর্মির এইরকম অবস্থার কারণ। বেশ একটা রহস্য আছে এর মধ্যে।
সৌমি জানিয়ে দেয়, সে উর্মির ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবে। এই বাড়িতে কি হচ্ছে, তা তাকে জানতেই হবে। কথাটা বলে একটু সন্দেহের নজরে তাকালো সানির দিকে। সানি অবশ্য উর্মির হাতটা ধরে আনমনে কিছু ভাবছিল। আর এইদিকে উর্মির সৎ মা মালিনী দেবী এখানে থাকার কথা বলতে গেলে, সৌমি বাধা দেয়। সে একাই উর্মির কাছে থেকে তাকে সুস্থ করবে।
এইসবটাই বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে শুনছিল এই বাড়ির পরিচারিকা রমা।
ঋষির চোখ তার দিকেই যায়, দুজনে চোখাচোখি হতেই রমা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়, তারপর সেখান থেকে চলে যায়। ঋষি রমাকে দেখে একটু অবাক হয়, আর যায় হোক তাকে দেখে বাড়ির পরিচারিকা বলে মনে হচ্ছে না।