ডিভোর্সের কথা বলতেই শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনেই বাবা সরাসরি বললেন, 'ডিভোর্সের পর আমার বাড়িতে উঠতে পারবি না, তোর কোন দায়িত্ব আমি নেব না।' ভরা লোকের সামনে বলায় খটকা লাগলেও আমি মোটেও অবাক হইনি। তিনিও ছিলেন আমার স্বামীর মতোই এক স্বৈরাচার, জালিম। যার পরিণতি হিসেবে কম বয়সে মা-বিহীন জীবন কাটাতে হয়েছে।
ভাগ্যিস আমার ইনকাম সোর্স ছিল, নাহলে পড়ে থাকতে হতো দুনিয়ার জাহান্নামে। আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। ভরা আসরে বললাম, 'আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবেনা, আমার দায়িত্ব আমি নিজেই নিতে পারব।'
শুনে বাবার মুখটা আরও থমথমে হলো। দেখে বোঝা যাচ্ছে আমার উপর ভীষণ রেগে। আমি সেসবে পাত্তা দিলাম না। ওনার রাগ ধুয়ে, উনি পানি খাক। পাশ থেকে কেউ বলল, 'বাবার উপরে কিভাবে কথা বলতেছে দেখছেন? বেয়াদপ মেয়ে। এইসব মেয়েদের সংসার টিকে না।'
কথা শুনে আমার মোটেও খা*রাপ লাগল না। আমি হাসলাম ক্ষীণ। সেটাতেও আমার দোষ হলো। শুনতে হলো, 'দেখ, আবার নির্লজ্জের মত হাসতেছে।'
আমি কাউকে কৈফিয়ত দিলাম না। বাইর থেকে নাহয় ভালোই দেখল, কিন্তু ঘরের ভেতরের কথা জানবে কিভাবে? না জেনেই কী সুন্দর তারা মন্তব্য করছে। করুক। এতে শান্তি পেলে, করুক তারা। আমি আমার সিদ্ধান্ত কোনভাবেই পরিবর্তন করব না। আমার মা যে ভুল করেছিল, আমি সেই ভুল করব না।
আমার বিয়ের সবে আটমাস হবে। হ্যা, মাত্র আটমাস। একবছরও হয়নি। বিয়ের প্রথমে ভালোই চলছিল, মানুষটাকেও ভালোই মনে হয়েছিল। কিন্তু দেড়মাস পেরোতেই হুট কথা কাটাকাটিতে সে আমাকে থা*প্প*ড় মারল। তখনও ছিলাম নতুন বউ, গায়ে লেগেছিল বেশ। কিন্তু নিজেকে মানিয়ে নিলাম এই সান্ত্বনা দিয়ে—সংসারে ওই একটু আধটু এমন হয়। আমার শ্বাশুড়ি আম্মা দেখে বুঝতে পারছিলেন, আমাদের মাঝে কিছু হয়েছে। আমি তাকে জানালাম, সে জানাল—এসব ধরে রাখতে নেই, সংসারে এগুলো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আমিও মেনে নিলাম। তারপর এভাবে ধীরে ধীরে কাটতে লাগল। সে আবারও আমার গায়ে হাত তুলল। এইবার আমি চুপ করে মেনে নিলাম না, মুখে যা বলার বলুক! গায়ে হাত তুলবে কেন? রাগ করে তার সঙ্গে বিছানায় আলাদা করলাম। দুদিন হলেই শ্বাশুড়ি বললেন, এভাবে চললে স্বামীর মন অন্যদিকে যাবে। তারপর পূর্বের মত এবারও মেনে নিলাম।
আমার শ্বাশুড়ি থেকে বেশি জ্বালাত আমার শ্বশুর। হ্যাঁ, ঠিক বললাম। মানুষ শুনলে হয়ত অবাক হবে। সবসময় খুঁত ধরত। তরকারি রান্না করলে, একদিন স্বাদ নেই, কোনোদিন লবণ হয়নি, কোনদিন ঝাল বেশি হয়েছে আবার আরেকদিন রান্নাই পারিনা। অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলাম তবে শ্বাশুড়ি মা ই নাহয় রান্না করবে, আমি শিখে নেব। শ্বাশুড়ির আপত্তি না থাকলে ঘোর আপত্তি ছিল শ্বশুরের—এইভাবে সংসার করব? শাশুড়ি এক হাতে সব করেছেন, আরও কত কী!
শুধু কী এতটুকুতেই আটকে ছিলেন? নাহ্। ফজরের আজান দিলেই, নামাজ পড়তে যাবেন, ঠিক তখনই আমাদের ঘরের সামনে এসে দরজায় ঢোল বাজাতে শুরু করতেন। নিজের ছেলে নামাজ না পড়লেও আমি ফজরে উঠতে দেরী করলেই হয়ে যেতাম জাহান্নামী। কেমন বউ আনল ঘরে?
যেদিন ওনার নামাজ থেকে ফেরার আগে উঠতে না পারতাম, সেদিন এসেই আবার জানালায় ঢোল বাজাতে লাগতেন। উনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়তেন, এটাই ভালো দিক। কখনও মিস করবেন না। ঝড়, বৃষ্টি যাই হোক। এটা নিয়ে ওনার অহংকারের শেষ ছিল না, নিজেকে জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়েছিলেন। যেন আল্লাহ ওনাকে জান্নাতের টিকিট দিয়ে রেখেছিলেন। আমি আমার মতই ছিলাম। কাউকে দেখিয়ে নামাজ পড়ার মানে নেই। ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পূর্বেই আমি নামাজ পড়ে নিতাম।
এছাড়াও শ্বশুরের ছিল বিশাল জমিজামা। ধান চাষ করেন সেখানে। জমি দেখে আসা, আইল ঠিকঠাক করা, পানি ঠিকঠাক যাচ্ছে কিনা–প্রতিদিন হলেও আমাকে এক দুবার যেতেই হতো। আবার ধান কাটা শেষে, ধান সিদ্ধ- শুকানোতেও কাজ করা লাগতো। অবশ্য শ্বাশুড়িই বেশি করতেন, এ কথা আমি অস্বীকার করব মা। রাস্তার মাঝে ধান শুকানো, ধানে পা দেয়া, বাও দেয়া সব জনসম্মুখে করত হতো–ওড়না কোনদিক থেকে কোন দিকে যেত.. কড়া রোদে কাজের সময় ওত ঠিকঠাক থাকা যায়? নিজের যথাসম্ভব চেষ্টা করতাম আমি। অথচ বিয়ের সময় শ্বশুর খুজেছিলেন—খাঁটি পর্দাশীল মেয়ে লাগবে! পর্দা ছাড়া চলা যাবে। এই হলো পর্দার নমুনা! জমিতে যাও, মানুষের সামনে ধান শুকাও, এখানে তাদের পর্দা লাগবে না!
আমি বুঝতে পারতাম আমার শ্বাশুড়ি জীবনটাও বেশি সুখকর ছিল না। তবে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তিনিও আমার মায়ের মতো ভুল করছেন। এ বিষয়ে তাকে কিছু বলিনি আমি।
বিয়ের তখন চারমাসে পড়ল। আমার স্বামীর সঙ্গে তর্ক লাগল একদিন, ধান শুকানো নিয়ে। আমি বললাম, রাস্তায় ওত মানুষ যাওয়া আসা করে, তাকিয়ে দেখে। এছাড়াও আমার রোদে সমস্যা হয়, মাথা ব্যথার সমস্যা। একটা লোক নিলে ভালো হয়।
সে বলেছিল, তার মা আগে করেনি? তাহলে আমার এত সমস্যা কেন? এটা নিয়েই লাগল তর্ক। সেদিনও নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে আমার হাতে হাত তুলেছিল। এইবার আগের তুলনায় বেশীই ছিল।
আমি কেঁ*দে*ছিলাম। অনেক কেঁ*দে*ছিলাম। কেঁ*দে খাবার দাবার ছেড়ে দিলাম। শ্বাশুড়ি মায়ের বোধহয় খারাপ লেগেছিল, ছেলেকে বকলেন। এরপর তিনি খাবার এনে আমাকে পরামর্শ দিলেন, ‘বাচ্চা নেও। বাচ্চা নিলে ঠিক হয়ে যাবে সব।’
আমি শুনলাম শুধু। সে এসে শুধু জিজ্ঞেস করল, খাইনি কেন? উত্তর না দেয়ায় আমাকে গালি দিল। সেদিন রাতে অনেক ভাবলাম। নিজের অতীত নিয়ে ভাবলাম। হ্যাঁ, কিছুটা হলেও আমার মায়ের জীবন দেখতে পারছিলাম নিজের ভবিষ্যতে। যদিও আমার মায়ের জীবন ছিল আরও করুণ, কষ্টের, অত্যাচারের। ছোটবেলায় বাবা মায়ের মাঝে ঘুমাতাম, মধ্যরাতে উঠে দেখতাম মা কা*দঁ*ছে, বাবা এসে চুলের মুঠি ধরে একের পর এক থা*প্প*র, ঘুষি মারছে। ভয়ে ওভাবেই মুখ চেপে থাকতাম আমি।
ছোটবেলা থেকে মায়ের ভ*য়*ঙ্ক*র জীবনের সাক্ষী ছিলাম আমি। বড় হয়ে শুধু ভাবতাম, মা এত ধৈর্য শক্তি নিয়ে কীভাবে থাকতো? মায়ের উত্তর ছিল, ‘তোরা, সন্তানেরা।
#ভুল,
Rumi Akter
حذف نظر
آیا مطمئن هستید که می خواهید این نظر را حذف کنید؟