ক্যাটাগরি: দুঃখের গল্প / সামাজিক গল্প
ট্যাগ: ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, স্মৃতি, একাকীত্ব, জীবন
গ্রামের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি টিনের ঘর। ঘরের সামনে একটি পুরোনো কদম গাছ, যার নিচে বসে বসে রফিক প্রায়ই বৃষ্টি দেখত। আজও বৃষ্টি নামছে—ঠিক যেমনটা নামত দশ বছর আগে, যখন মায়া তাকে শেষ চিঠিটা লিখেছিল।
রফিকের জীবনে আনন্দ বলতে ছিল খুব অল্প। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়, মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে তাকে মানুষ করেছেন। দারিদ্র্য তাকে শক্ত করেছিল, কিন্তু মনটা ছিল ভীষণ নরম। কলেজে পড়ার সময় মায়ার সাথে পরিচয়। মায়া ছিল শহর থেকে আসা, চোখে স্বপ্ন আর মুখে সবসময় হালকা হাসি। রফিক প্রথম দিন থেকেই জানত—এই মেয়েটাকে ভালোবাসা সহজ, কিন্তু পাওয়া কঠিন।
তবুও তারা ভালোবেসেছিল। কদম গাছের নিচে বসে ভবিষ্যতের কথা বলত, ছোট্ট একটা ঘর, জানালার পাশে ফুলের টব, আর সন্ধ্যাবেলা একসাথে চা। মায়া বলত,
“জানো, সুখ খুব বড় কিছু না—যার পাশে মন শান্ত থাকে, সেটাই সুখ।”
কিন্তু জীবন সবসময় গল্পের মতো হয় না।
মায়ার বাবা ছিলেন কঠোর মানুষ। তিনি কখনোই চাইতেন না, দরিদ্র একটি ছেলের হাতে মেয়ের ভবিষ্যৎ তুলে দিতে। শেষ পর্যন্ত শহরে ভালো চাকরি করা এক ছেলের সাথে মায়ার বিয়ে ঠিক হয়। মায়া কাঁদতে কাঁদতে রফিককে বলেছিল,
“আমি লড়তে পারলাম না রফিক। ক্ষমা করে দিও।”
রফিক কিছু বলেনি। সে জানত, কিছু কথা উচ্চারণ না করাই ভালো। বিদায়ের দিন শুধু একটি চিঠি হাতে পেয়েছিল সে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—
“যদি কখনো খুব একা লাগে, বৃষ্টির দিকে তাকিও। আমি বিশ্বাস করি, একই বৃষ্টি আমাদের দুজনকেই ভিজিয়ে দেবে।”
বিয়ের পর মায়া চলে যায় শহরে। রফিক গ্রামেই থেকে যায়। পড়াশোনা শেষ করে ছোট একটা চাকরি পায়, মাকে নিয়ে সংসার চালায়। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, সে স্বাভাবিক জীবনই কাটাচ্ছে। কিন্তু রাতে ঘুমানোর আগে, সে এখনো সেই চিঠিটা বের করত। কাগজটা ভিজে ভিজে নরম হয়ে গেছে—চোখের জল আর বৃষ্টির পানিতে।
কয়েক বছর পর খবর আসে—মায়া সুখী নয়। তার স্বামী ভালো মানুষ হলেও, ভালোবাসাটা আর ছিল না। তারপর একদিন হঠাৎ খবর এল, মায়া অসুস্থ। অনেক চেষ্টা করেও রফিক আর দেখা করতে পারেনি। সমাজ, দূরত্ব আর সময়—সব মিলিয়ে মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শেষ খবরটা আসে বর্ষার এক সকালে। মায়া আর নেই।
সেদিন রফিক কদম গাছের নিচে বসে ছিল অনেকক্ষণ। বৃষ্টি পড়ছিল অবিরাম। মনে হচ্ছিল, আকাশটাও যেন কাঁদছে। সে চিঠিটা আবার পড়ল, শেষ লাইনে এসে থেমে গেল—
“আমি হয়তো তোমার হতে পারলাম না, কিন্তু তোমার স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে চাই।”
আজ দশ বছর পরও রফিক বৃষ্টি দেখলে থেমে যায়। মানুষ ভাবে, সে বৃষ্টিপ্রেমী। কেউ জানে না, প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সে হারানো একটা জীবন, হারানো একটা ভালোবাসা আর অপূর্ণ স্বপ্নগুলোকে মনে করে।
কদম গাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মায়া নেই।
আর কিছু দুঃখ—কখনো শেষ হয় না, শুধু নীরব হয়ে যায়।
আপনি চাইলে আমি
আরও বেশি শব্দে,
খুব ছোট ভাষায়,