ছায়ার খোঁজে
রাত তখন প্রায় বারোটা। কলকাতার শহরে রাতের এই সময়টা অদ্ভুত নিঃশব্দ। রাস্তায় গাড়ি চলে টুপটাপ, মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক, আর দূরে কোথাও ট্রেনের হুইসেল। আর ঠিক তখনই, একা একজন যুবক হেঁটে চলেছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে। নাম তার অর্ণব।
অর্ণবের চোখে ঘুম নেই বহুদিন। সে ঘুমোলে স্বপ্ন দেখে—একটা মেয়ে, ছায়ার মতো তার চারপাশে ঘোরে। চুলে লাল ফিতা, পরনে নীল শাড়ি। মুখটা ধরা যায় না, কিন্তু কণ্ঠস্বর—সে যেন বহু চেনা, বহু আপন। প্রতিদিন সেই স্বপ্ন, প্রতিদিন সেই কণ্ঠ।
তিন বছর আগে এমনটা হতো না। অর্ণব ছিল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তো। তখন তার জীবনে ছিল একটি মানুষ—অদ্বিতা। শান্ত, মিষ্টি, বইয়ের পাতার মতো গভীর। তারা একসাথে রবীন্দ্রনাথ পড়ত, ঘুরত বইমেলায়, আর স্বপ্ন দেখত একসাথে থাকা, একসাথে জীবন গড়ার।
কিন্তু হঠাৎ একদিন, সব থেমে গেল। এক ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনায় অদ্বিতা চলে গেল। কেউ বলতে পারে না ঠিক কী হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ফোন এলো, "তিন ঘণ্টা চেষ্টার পরেও বাঁচানো গেল না।" আর তারপর থেকেই অর্ণবের জীবনে নেমে এল ছায়া।
প্রথম দিকে সবাই ভেবেছিল, সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। বন্ধু, পরিবার—সবাই পাশে ছিল। কিন্তু অর্ণব বেছে নিল একাকিত্বকে। সে চুপচাপ হয়ে গেল, ক্লাসে যাওয়া বন্ধ, পড়া বন্ধ, এমনকি লেখাও না। সে শুধু সন্ধ্যা হলে বেরিয়ে পড়ে। অজানা এক টানে।
এক রাতে, হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেল শহরের এক পুরোনো বাড়ির সামনে। ছাদের কোণায় ঝুলছে একটা নামফলক—“অদ্বিতা ভবন”। চমকে উঠল অর্ণব। এতদিন ধরে এই বাড়িটা চোখে পড়েনি? না কি আজ প্রথম দেখল?
বাড়ির গেট খোলা। ধীরে ধীরে ভেতরে পা রাখল সে। বাড়ির ভেতর যেন সময় থেমে আছে। ধুলো জমেছে, দেয়ালের রং উঠেছে, তবু এক অদ্ভুত শান্তি আছে। হঠাৎ কেউ যেন ডাকল, “অর্ণব!”
সে চমকে তাকায়। কেউ নেই। আবার সেই ডাক, এবার কাছ থেকে, মৃদু স্বরে। “অর্ণব, এখানে এসো।”
সে এগিয়ে যায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে। একটা দরজা অল্প খোলা। ভেতর থেকে হালকা আলো আসছে। দরজাটা ঠেলে খোলে সে।
ঘরে বসে আছে এক মেয়ে, পরনে নীল শাড়ি, চুলে লাল ফিতা। মুখে হাসি। ঠিক যেমন স্বপ্নে দেখে অর্ণব।
— “অদ্বিতা?” সে কাঁপা কণ্ঠে বলে।
মেয়েটি তাকায়, “তুমি এসেছো অবশেষে।”
— “কিন্তু… তুমিতো… তুমি তো…” অর্ণব কথা শেষ করতে পারে না।
— “হ্যাঁ, আমি চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কিছু থেকে গিয়েছিল এই বাড়িতে, এই ঘরে। আমার কিছু কথা, কিছু অনুভব, কিছু প্রেম…”
অর্ণবের চোখে জল। সে এগিয়ে যায়। মেয়েটি বলে, “তুমি কি জানো, মৃত্যুর পরও কিছু প্রেম থেকে যায়, কিছু টান অমর হয়? আমি অপেক্ষা করেছি, জানতাম তুমি একদিন ঠিক আসবে।”
— “তুমি কি… ফিরে এসেছো?”
— “না, আমি নেই। আমি ছায়া। স্মৃতির ছায়া। কিন্তু যতদিন তুমি ভালোবাসবে, আমি থাকব।”
অর্ণব হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। “আমি কী করব?”
অদ্বিতা হাসে, “লেখা শুরু করো। তোমার কলমে আমি থাকব। কাগজে, বাক্যে, ছন্দে। আমি হারিয়ে যাব না।”
হঠাৎ করে আলোটা ম্লান হয়ে আসে। ঘরটা ফাঁকা। আর কেউ নেই। অর্ণব একা। দরজার ওপাশে শুধু নীরবতা।
---
পরদিন সকাল। অর্ণব বসেছে খোলা জানালার পাশে। হাতে কলম। বহুদিন পর কাগজে শব্দ নামছে—
“অদ্বিতীয় প্রেম বলে কিছু থাকে, যা মৃত্যুকেও অতিক্রম করে। আমি এক ছায়ার খোঁজে ছিলাম, আর পেয়েছি ভালোবাসার অমর রূপ…”
গল্প, উপন্যাস, কবিতা—অর্ণব লিখতে থাকে। তার লেখায় উঠে আসে অদ্বিতা, উঠে আসে ছায়া, উঠে আসে প্রেম।
মানুষ পড়ে, আবেগে ভেসে যায়। কেউ জানে না অর্ণবের জীবনের এই গল্প, কিন্তু অনুভব করে।
আর অর্ণব? সে জানে, প্রতিটি লাইনের আড়ালে এক ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—চুপচাপ, নিঃশব্দে, ভালোবেসে।
---
শেষ।