আপনাদের আজ একটা গল্প বলবো আমার জীবনের গল্প। আমি জানি পৃথিবীটা গোল। কিন্তু এতটা গোল এটা নিয়ে একটু হলেও সংশয় ছিল। কাল সন্ধেতে সেটা কেটে গেল। না এটা কোনো গল্প নয়। এর প্রতিটা শব্দ সত্যি।
চলে যাই প্রায় বছর কুড়ি আগে। আমি তখন ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ার। সঠিক মনে নেই তবে কোন একটা কারণে বাপি(বাবা) সেদিন সঙ্গে ছিল। সম্ভবত আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম, আর বাপি কোনো মিটিং থেকে। একই বাসে ফিরছি দুজনে। হঠাৎই একটা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষকে লোকে আচমকা পকেটমার সন্দেহে মারধোর করতে শুরু করলো বাসের মধ্যেই। লোকটার পরনে একটু অপরিচ্ছন্ন পোশাক। অযত্নে তামাটে হয়ে যাওয়া চামড়া। খোঁচা খোঁচা না কাটা দাড়ি। কিন্তু মুখটা বেশ নিরীহ। লোকটা নাকি কার পকেট থেকে কি চুরি করে তার হাতের ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়েছে। আমি আর বাপি আরও দু একজন লোক চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলাম। আমাদের চেঁচামেচিতে লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এবং ব্যাগ সার্চ করে দুটো রঙিন টিপের পাতা, গোটা বারো কাঁচের চুড়ি আর একটা হেয়ারব্যান্ড ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। কিল, ঘুষি খেয়ে মানুষটা হাঁপাচ্ছিলো। আমি ব্যাগ থেকে জল বের করে দিয়েছিলাম। লোকটা জল খেয়ে দম নিয়ে বলেছিল, আমি চোর নই। আমি রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে কাজ করি। আমার বাড়িতে একটা বছর দশের মেয়ে আছে। তার ডেঙ্গি হয়েছে খবর এসেছে। আমি গিয়ে যেন তাকে সুস্থ দেখতে পাই, তাই বারবার ঠাকুর প্রণাম করছিলাম। সেজন্যই ওই ভদ্রলোকের গায়ে দুবার হাত ঠেকে ছিল। ভেবেছে পকেটমার। লোকটাকে সবাই মিলে যেমন মেরে হাতের সুখ করে নিয়েছে, তেমনই গোটা বডি সার্চও করে নিয়েছিল, না কিছুই পায়নি।
একটু পরে জানা গিয়েছিল, কারোর কিছু চুরিই হয়নি। শুধু লোকটির ঘন ঘন ঘড়ি দেখা, বিচলিত স্বভাব, অস্থিরতা দেখেই লোকে ওকে পকেটমার ভেবেছিল।
সত্যি বলতে কী মানুষটির সঙ্গে বাপি দু একটা কথা বলেছিল, কিন্তু আমার সেভাবে তার মুখ মনে ছিল না। এমন কত মানুষের সঙ্গেই তো আমাদের পথে পরিচয় হয়।
কাল সন্ধেতে দাঁড়িয়ে আছি একটা ওষুধের দোকানের সামনে।আচমকা একজন মানুষ সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, দিদিমণি কেমন আছেন?
আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে আমি চিনি না। স্কাইব্লু শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট, হাতে ঘড়ি...আমি ঘাড় নেড়ে বললাম আমি তো চিনতে পারছি না আপনাকে। ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন খাঁকি পোশাকের পুলিশ। কিছু বোঝার আগেই ভদ্রলোক বললেন, সেই যে আসানসোল কৃষ্ণনগর বাসে.... পকেটমার...আপনি আর আপনার বাবা বাঁচিয়েছিলেন।
বাসে একটি মানুষকে পকেটমার সন্দেহে মারের হাত থেকে বাঁচানোর ঘটনাটা আমি আমার 'অনুভবে তুমি' উপন্যাসে এড করেছিলাম। তাই ঘটনাটা আজও মনে ছিল। বললাম, হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু আপনি?
ভদ্রলোক এক মুখ সরল হেসে বললেন, আমিই তো সেই। আসলে খনিতে কাজ করতাম তো তাই রংটা কালো হয়ে গিয়েছিল। হয়তো সেইজন্যই চিনতে পারছেন না। আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি। কত বছর আগের দেখা তবুও একবার দেখেই চিনেছি। মুখটা একই আছে আপনার। শুধু তখন একটু রোগা ছিলেন।
আমি স্তম্ভিত।
ভদ্রলোক বললেন, আপনার বাবা কেমন আছেন?
আমি বললাম, মারা গেছেন আট বছর হলো।
সহজ ভাষায় বললেন, মানুষটা খুব পরোপকারী ছিলেন। আমার হাতে টাকা দিয়ে বলেছিলেন, মেয়েকে ফল কিনে দিও।
বাপির নামের পাশে পরোপকারী কথাটা শুনতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম ছোট থেকে। কিন্তু আমার চোখ বাঁচিয়ে বাপি যে ওই বাসের মধ্যেই এনাকে টাকা দিয়েছিলেন সেটা জানতাম না। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন নিজের মেয়ের। মেয়ে এখন পুলিশ। বছর তিনেক চাকরি পেয়েছে।
মেয়েটি নমস্কারের ভঙ্গিমা করে বললো, বাবা যে কতবার ওই বাসের ঘটনাটা আমায় বলেছে ভাবতে পারবেন না। আমি বললাম, এখন কোথায় পোস্টিং?
মেয়েটি বলল কাছেই। এখানেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বাবা, মা আর আমি।
অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভাসছি গতকাল সন্ধে থেকে। আমিও পাগলের মত মেয়েটার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম....সেই সবুজ কাঁচের চুড়িগুলো দেখবো আশা করে কিনা জানি না। মানুষের মন তো কখন যে কোন দিকে ধাবিত হয় আমরা কেউ জানি না। সেই রঙিন টিপ, গোলাপি হেয়ারব্যান্ড আর সবুজ কাঁচের চুড়িগুলো ভেসে উঠেছিল মুহূর্তের জন্য আমার চোখের সামনে। 'অনুভবে তুমি' লেখার সময় বিজুকে যখন বাঁচিয়েছিল অহনার বাবা তখনও কি ভেবেছি, এত বছর পরে আবার দেখা হয়ে যাবে এই মানুষটার সঙ্গে! এত বছর পরেও যে মানুষটি ওই অতি সামান্য উপকার করা ব্যক্তিকে মনে রেখেছে এটাই বিস্ময়কর লাগলো! সাধারণত যাদের উপকার করেছি তারাই আড়ালে নিন্দে করেছে, এটাতেই অভ্যস্ত। উনি যে মনে রেখেছেন ঐ সামান্য উপকার এটাই আশ্চর্যের!
সত্যি পৃথিবীটা গোল।
©কলমে- অর্পিতা সরকার