#
তৌহিদুর রহমানের ফোন যেন থামতেই চাইছিল না। একটার পর একটা কল আসছে, প্রত্যেকটি তার বিজনেস পার্টনারদের কাছ থেকে।
"আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, তৌহিদ ভাই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমরা আর কোনোভাবেই পার্টনারশিপ চালিয়ে যেতে পারবো না। আশা করি আপনি বুঝবেন,"— এ রকম কথাগুলোই বারবার ভেসে আসছে।
রহমান পরিবারের এত বছরের সম্মান আজ যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছে।
সকালে সবাই নিউজে যা দেখেছে, তাতেই তারা নিশ্চিত যে তৌহিদুর রহমান এখন একজন সন্দেহভাজন ক্রিমিনাল। এবং কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সাহস পাচ্ছে না।
তৌহিদুর রহমান হতাশ হয়ে নিজের কপালে হাত রেখে বসে আছেন। তার চারপাশে যেন নিস্তব্ধতার কালো মেঘ জমে গেছে।
তবে এতে ফারাবীর মেজো চাচা, কামরুল রহমানের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
"এই বাড়িতে থাকা আর সম্ভব না। নিজের ভাইয়ের কাণ্ড-কারখানার জন্য আমাদের পরিবারের সম্মানও আজ নষ্ট হয়ে গেল," মেজো চাচা কামরুল রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন।
ছোট চাচা সায় দিয়ে বললেন, "পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। আমাদের বাঁচতে হবে।"
তৌহিদুর রহমান কিছুমাত্র মাথা তুললেন না। কিন্তু তার ভেতরে যেন ক্রোধ জমে উঠছে।
তিনি হঠাৎ ছেলের দিকে তাকালেন। ফারাবী বাবার এমন দৃষ্টিতে কিছুটা চমকে উঠলো।
"খুঁজ নে, ফারাবী! দ্রুত খুঁজ নে! এই অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে আমি শেষ করে দেবো!" তৌহিদুর রহমানের কণ্ঠে এক ভয়ংকর প্রতিশোধের আগুন।
"বাবা, কিন্তু আমরা..." ফারাবী কিছু বলার চেষ্টা করলো।
—২৪ ঘণ্টা! ২৪ ঘণ্টা সময় দিলাম তোকে। আমার এই দুর্দশার পেছনে যার হাত আছে, তার নাম আমাকে জানাবি। তৌহিদুর রহমানের কথায় যেন রক্তের ভয়ংকর গন্ধ লেগে আছে।
ফারাবী আর কিছু বলতে পারলো না। তার মাথায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো—এই চক্রান্তের পেছনে আসলেই কে? এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কি আদৌ সম্ভব?
________________________
দুপুরের লাঞ্চের সময় তানজিলা বাসায় ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখলো, আরীবী তার গ্র্যান্ডপা, তানজিলার বাবার সাথে খেলায় মগ্ন। মেয়েটার প্রাণোচ্ছল হাসি আর গ্র্যান্ডপা’র স্নেহমাখা উচ্ছ্বাসে পুরো ঘর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
তানজিলা মুচকি হাসলো। মেয়ের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
“মাম্মা, এখন লাঞ্চের টাইম। এসো, লাঞ্চ করে নাও। মাম্মা তোমায় খাইয়ে দেবে।”
কিন্তু আরীবী তাতেই ছোট্ট মাথা নেড়ে বললো,
“না না! আমি গ্র্যান্ডপা’র সাথেই খাবো। গ্র্যান্ডপা আমায় খাইয়ে দেবে।”
তানজিলা মেয়ের জেদ দেখে মৃদু হাসলো। আরীবীর গালে আদুরে একটা চুমু খেয়ে বললো,
“ঠিক আছে, তবে চল, গ্র্যান্ডপা’র সাথেই টেবিলে যাই।”
তানজিলা মেয়েকে কোলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। ছোট্ট মেয়েটাকে পাশে বসিয়ে নিজেও জায়গা নিলো। কিছুক্ষণ পর রাকিব শেখ টেবিলে এসে বসলেন। তার মুখে ছিল এক প্রশান্তির হাসি।
এরপর তানজিলার কাকীয়া এসে টেবিলে যোগ দিলেন। সবার উপস্থিতিতে টেবিলের পরিবেশ যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো।
রাকিব শেখ খাবার নিতে নিতে বললেন — “কাল থেকে আমি ও অফিসে জয়েন করবো। অনেক কাজ জমে গেছে।”
তানজিলা মৃদু হাসি দিয়ে বললো— “ভালোই হলো। কিন্তু শ্রাবণের খবর কি? ও কি আসবে না?”
— কাল-পরশুর মধ্যে চলে আসবে। সব ঠিকঠাক করে নিয়েছে।
— গুড। কাল আমাদের একটা বড় ডিল হতে যাচ্ছে। আশা করছি, আমরা সফল হবো।”
— ইনশাআল্লাহ।
এদিকে আরীবী তার ছোট্ট গোল চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে তার মায়ের প্রতিটি কথা মন দিয়ে বুঝতে চাইছে।
______________________
রহমান বাড়ির ডাইনিং টেবিলে সবে মাত্র লাঞ্চ শুরু হয়েছে। সারাদিনের অশান্তি আর চাপা উত্তেজনার পর, খাবারের টেবিলে যেন একটা মুহূর্তের জন্য শান্তি ফিরে এসেছিল।
ঠিক তখনই, তৌহিদুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এসে জানালো স্যার, ব্যাংক থেকে জরুরি নোটিশ এসেছে।
তৌহিদুর রহমান চেয়ারে সোজা হয়ে বসে নোটিশটি হাতে নিলেন। দ্রুত চোখ বুলিয়ে যা বুঝলেন, তাতে যেন তার শরীর জমে গেল। নোটিশে লেখা— “এক দিনের মধ্যে ব্যাংকের সমস্ত ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, আপনার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।”
তৌহিদুর রহমান কোনো কথা বললেন না। হাত থেকে নোটিশটা নিচে পড়লো। পুরো বাড়িতে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
ডাইনিং টেবিলের সবাই থমকে গেল। পরিবারের প্রতিটি সদস্য চুপচাপ তৌহিদুর রহমানের দিকে তাকিয়ে রইল। আর তৌহিদুর রহমান মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে রইলেন।
ঠিক তখনই, তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো শীতল শিকদারের নাম। পরিবারের সবাই তার প্রতিক্রিয়া দেখছিল। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে তিনি ফোনটি রিসিভ করলেন।
“হ্যালো,” তৌহিদুর রহমানের কণ্ঠে ক্লান্তি স্পষ্ট।
অন্য প্রান্ত থেকে শীতল শিকদার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তৌহিদ ভাই, আমি দুঃখিত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমার মেয়ের সাথে আপনার ছেলের বিয়েটা সম্ভব নয়। এনগেজমেন্টটা এখানেই শেষ। রিংটা আমরা ফেরত পাঠিয়ে দেব।”
তৌহিদুর রহমান কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। শীতল শিকদার খট করে ফোন কেটে দিলেন।
তৌহিদুর রহমান ফোনটা টেবিলের ওপর রাখলেন। তার হাত কাঁপছিল। মাথাটা আরও নিচু হয়ে গেল। আর পরিবারের সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল।
সারাদিনের টানাপোড়েনের পর, এটাই ছিল যেন চূড়ান্ত আঘাত। রহমান পরিবারের এই অসহায় মুহূর্তে ঘরে নেমে এলো গভীর নীরবতার ছায়া।
চলবে,,,,
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক : https://www.facebook.com/share/p/1E6Ccw4Dw1/