উনুন থেকে ছাই উঠাতে একটু দেরি হওয়ায় মায়ার সৎমা তার চুলের মুঠিতে টেনে ধরে। মায়া কিছু বোঝার আগে তাকে রান্না ঘরের দুয়ারে এনে ফেলে তার সৎমা জেসমিন। ক্রোধে গর্জন দিয়ে জেসমিন শুধায়,
“জমিদারের মাইয়া, চুলার ছাই উঠাইতে দেরী করলি কেন?”
জেসমিনের ক্রোধের গর্জনে মায়া ভয় পায়। সবসময়ই জেসমিনের ভয়ে তটস্থ থাকে মায়া। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। মিনমিন কন্ঠে জবাব দেয় মায়া।
“এখন উঠিয়ে নিচ্ছি আম্মা।”
কথাটা বলে ক্লেশ যুক্ত শির আর চরণ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মায়া। তখন জেসমিন ক্রোধে মায়ার থুঁতনি বরাবর নিজের হাত দিয়ে আঘাত করে। সঙ্গে,সঙ্গে মায়ার দুইহাত চলে যায় তার থুতনিতে। জেসমিন রাগে ফুঁসতে,ফুঁসতে কড়া সুরে চেঁচালেন,
“নবাবের বেটি, ভাব কমাইয়া নিবি। নাইলে আজকে কী করছি এর থাইকা বেশী করমু। সতীন গেছে তো গেছে আপদ দিয়া গেছে।”
কথাটা বলে সে জোর কদমে ঘরে ঢুকে যায়।
মায়ার থুতনির ব্যথায় তার মাথাও ব্যাথা হয়ে যায়। মৃত্তিকায় পিক ছুঁড়ে মারতে এক ফালি রক্ত বেড়িয়ে আসে।মায়া তীব্র ভঙ্গিতে কলপাড় যায়। মুখে পানি নিয়ে কিছুক্ষণ ধোঁয়। যাতে করে রক্ত বন্ধ হয়। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা দমানোর চেষ্টা চালায়।
চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে জোর কদমে রান্না ঘরে যায়। মাটির উনুন থেকে ছাই উঠিয়ে সেটা রান্নাঘরের পাশের গর্তে ফেলে দেয়। চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়াচ্ছে। প্রতিদিন ঠিক পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে মায়া। উঠে নামাজ আদায় করে,কোরআন তেলাওয়াত করে। রোজকার নিয়মে, উনুন থেকে ছাই ফেলে। রান্নার জোগাড় করা,শিলপাটায় মসলা বাটা, চাল ধোঁয়া থেকে শুরু করে, এঁটো প্লেটগুলো ধোঁয়া সবই তার দৈনিন্দন জীবনের রুটিন। অসুস্থ থাকায়,নামাজ নেই সেজন্য আজকে একটু দেরি হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। বড়জোর ত্রিশ মিনিট কী চল্লিশ মিনিট। তাতেই তার এই হাল করেছে জেসমিন। মাঝেমধ্যে নিজের ভাগ্য নিয়ে একগাদা অভিযোগ জমে। এতো কষ্ট কেন তার জীবনে? মায়া অনুভব করে মাথার ব্যথা জেনো বেজায় তীব্র হচ্ছে। পা ফেলো হেঁটে দালানের ভেতরে প্রবেশ করে মায়া। জেসমিনের কক্ষে গিয়ে মায়া ন্যাতানো গলায় শুধায়,
“আজকে কী রান্না হবে?”
“ফ্রিজে রাখা আছে নিয়ে কাইটা দে। ওইদিকটা সামলা আমি আইসা রান্না বসামু।”
মায়া নিঃশব্দে প্রস্থান করে। ফ্রিজ থেকে তরকারী বের করে রান্নাঘরে যায়। নেত্রপল্লবে অম্বু ঝড়ে পড়ছে। নিজেকে সামলে কাজগুলো করে নেয় মায়া। একটু পর আবার কলেজে যেতে হবে তাকে।
রান্নার ঘর গুছিয়ে, তৈরী হতে চলে যায় মায়া। তখন তার সৎ বোন ছোট্ট রায়া আসে মায়ার কাছে। মায়ার থুতনির দিকে তাকিয়ে সে মসৃণ কন্ঠে শুধায়, “মায়া আপু আম্মু তোমায় আবার মেরেছে? আজকে আব্বু কল দিলে আমি বিচার দেবো।”
“ কিছু হয়নি রায়া। তুমি স্কুলে যাবে না?”
“যাবো। তুমি তো কলেজ যাবে। কিছু খাবে না?”
“খিদে নেই।”
রায়া মাথা নাড়ায়। মায়া রায়ার যাওয়ার পাণে তাকায়। এই ছোট্ট মেয়েটার চোখে নিজের জন্য একটু টান দেখতে পায় মায়া। মা আলাদা হলেও বাবা তো এক। কিন্তু রায়ার বড় বোন যে মায়াকে সহ্যই করতে পারে না। মায়া ও দূরে,দূরে থাকে রিয়ার থেকে। নিজেকে তৈরী করে ঘড়িতে সময় দেখে মায়া। ব্যাগ গুছিয়ে নিতে রিয়া আসে মায়ার কক্ষে। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট মায়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “ভাড়ার টাকা।”
মায়া বাক্যব্যয় করে না। রিয়া মুখ বাকিয়ে চলে আসে। তখন মায়া টাকাটা নিয়ে বেড়িয়ে যায়। মায়া যাওয়ার পেছন দিয়ে রিয়া ও রওনা হয়। তারা দু'জনেই ইন্টার সেকন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তবে দু'জনের কলেজ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
★★★
"শারফাজ রেজওয়ান চৌধুরীকে আমি ভীষণ ভালোবাসি খুব করে পেতে চাই। আপাতত আমার মনে এই আশার চেয়েও বড় আর কিছুই নেই।"
ছোট্ট এক চিরকুটে আঁকড়ে ধরে এই লেখা। কলম থেমে গেল নিহির হাতের গায়ে। সূক্ষ্ম, দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চিঠির পাশে বসে থাকে, যেন সেই শব্দবিহীন নিঃশ্বাসে লুকিয়ে আছে তার সমস্ত অভিমর্ম। অসংখ্য চিঠির মাঝে এই ছোট্ট খাতাটুকু যেন একটা নিঃশব্দ গাথা, যেখানে প্রতিটি অক্ষর তার হৃদয়ের অচেনা, গভীর আঘাতের সাক্ষী।
চিঠিটা ভাঁজ করে সে নিখুঁত যত্নে নীল রঙের খামে ঢুকিয়ে দিল। নীল— রঙটি যে শুধু তার প্রিয় তা নয়; বরং নীলের আভায় ধরা দিয়েছে তার অন্তরের সেই বিষাদময় প্রেমের বুনন। নীল খামের ভেতর নিহি রাখে তার অজানা কথা, অব্যক্ত আবেগ। ভালোবাসার ব্যপারটা নিহির কাছে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বি'ষ পান করার মতন। যেই বিষ ইতোমধ্যে সে গলদ করে নিয়ে, স্বেচ্ছায় ভোগান্তি বেছে নিয়েছে।
চিঠিগুলো ঝুড়িতে সাজানো, তালাবদ্ধ। প্রতিটি শব্দকে সে ভ্রূণের মতো লালন করছে এতোকাল ধরে। ভোরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে নিহি উঠে দাঁড়ায়। লিভিং রুমে এসে উঁকি ঝুঁকি দিতে পেছন থেকে তার মামী মারিয়াম বলে, "উঁকিঝুঁকি না দিয়ে বলো কাকে খুঁজছ?"
নিহি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে বলে, "সামিয়া উঠেনি?"
"না। ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তুমি যাও তাকে সহ বাকীদেরও ডেকে আনো।"
নিহি আমতাআমতা করে বলে, "শুধু সামিয়াকে ডাকব।"
"শারফাজ আর বাকীরা কী দোষ করল?"
"উঠে গেছে মনে হয়।"
মারিয়াম বলে, "হ্যাঁ। বাকীরা না উঠলেও শারফাজ খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে।"
নিহি সূক্ষ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামিয়ার রুমে যায়। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এতে করে নিহি তাকে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। সামিয়ার কানে সে ডাক পৌঁছালে সে বলে, "আরেকটু পর উঠব।"
"তাড়াতাড়ি আয়। মামী ডাকছে।"
"আমাকে না জ্বালিয়ে তাহসিন শালা বা আরিশ ভাইকে জ্বালা। বেটারা বহুত সুখ করে ঘুমাচ্ছে।"
"
Mdemran11
Slet kommentar
Er du sikker på, at du vil slette denne kommentar?