মিত্র বাড়ির পরিবেশ এখন পুরো থমথমে। সবাই মনমরা হয়ে ডাইনিং রুমে বসে আছে। মিসেস মিত্র সেই যে আয়ুশ আসার থেকে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে এখনো খোলেননি। বাইরে থেকে আয়ুশ ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে ওনাকে। উনি এবার বিরক্ত হয়ে বললেন - তোর বউকে নিয়ে এখান থেকে চলে যা পাপাই। আমি আর তোর মুখটাও দেখতে চাইনা।
* মপি মা প্লিজ একবার দরজাটা খোলোনা... প্লিজ একবার আমার কথাটা শোনো... প্লিজ মপি মা প্লিজ...
মিসেস মিত্রের স্বামী আলোকবাবু বললেন - কী করছিস গিরি? ছেলেটা তখন থেকে হাত-মুখ না ধুয়ে এখানে দরজার সামনে পড়ে আছে... দরজাটা খুলে দাও মুমুয়ী... আমি বলছি খোলো...
মুমুয়ী দেবী এসে দরজাটা খুলে দিলেন...
দরজাটা খুলতেই আয়ুশ ভেতরে ঢুকল। মুমুয়ী দেবী ধীর পায়ে এগিয়ে যেয়ে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসলেন।
আয়ুশ মুমুয়ী দেবীর পায়ের কাছে বসল...
* মপি মা... মপি মা প্লিজ একবার আমার কথাটা শোনো... প্লিজ...
* আমার তোর কোনো কথা শোনার নেই পাপাই! তুই এখান থেকে চলে যা।
* এভাবে বোলনা মপি মা!!!
* খুব খারাপ লাগবে বল??? লুকিয়ে বিয়েটা করার আগে একবার আমাদের কথা মনে পড়লনা তোর???
* সরি মপি মা.... পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমাকে হঠাৎ এই বিয়ের সিদ্দান্ত নিতে হয়।
মুমুয়ী দেবী চুপ করে রইলেন। অশোকবাবু আয়ুশকে বললেন -- তুই বল পাপাই।
আয়ুশ একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করল -- মপি মা, বাবা তোমাদের আমি ফোন প্রায়ই হসপিটালে আমার সিনিয়ার, গড়ফাদার ডঃ ব্যানার্জীর কথা বলতাম। মনে আছে?
অশোকবাবু বললেন -- হ্যাঁ রে পাপাই। তুই বলতিস উনি নাকি তোকে নিজের ছেলের মত ভালোবাসেন... সবসময় তোর খোঁজখবর রাখতেন। আমাদের সাথেও তো কথা হয়েছে দু-তিনবার। বড় ভালো লোক উনি।
* হ্যাঁ বাবা, বলতে পারো ওই অচেনা দেশে অচেনা হয়েও আমার ভীষ্মই আপন ছিলেন ডঃ ব্যানার্জী। অনেক অনেক উপকার করেছেন। আজ আমার এই সাফল্যের পেছনে ওনার অবদান কিছু কম নয়।
মুমুয়ী দেবী এবার মুখ খুললেন -- ছিলেন কেন বলছিস পাপাই?
* মপি মা, কারণ পরশু ভোররাতেই উনি মারা গেছেন।
এটা শুনেই অশোকবাবু চমকে উঠে বললেন -- কী বলছিস পাপাই! উনি মারা গেলেন?
মুমুয়ী দেবীও প্রচণ্ড অবাক হলেন কথাটা শুনে।
আয়ুশ আবার বলতে শুরু করল -- পঁচিশ দিন আগে হসপিটালে ডিউটি করতে করতে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা তাড়াতাড়ি ওনাকে আমাদের হসপিটালে অ্যাডমিট করে চিকিৎসা শুরু করি। কিন্তু টেস্টের পর জানা যায় উনি ডায়াবেটিসের পেশেন্ট হওয়ায় দুটো
কান্নাভেজা চোখে হতবুদ্ধি হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের কারোর সম্মতি না থাকলেও দুজনেই নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির জন্য হসপিটালে পরদিন রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করলাম। উনি নিজে সাক্ষী দিলেন। সিঁদুরও পরালাম। ডক্টররা বললেন ওনার সিচুয়েশন এখন অনেকটা ভাল আমরা যেন আজ রাত্রেই অপারেশনটা করে নিই। ও টিতে ওনাকে নিয়ে যাওয়ার আগে উনি ওনার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সবসময় হাসিখুশি থাকতে বললেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন "আমার মেয়েটাকে সামলে রেখো আয়ুশ। ভালো থেকো তোমরা।" ওনাকে অভয় দিয়ে আমরা ও টিতে নিয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে উনি অপারেশন টেবিলেই মারা গেলেন। ওনার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে আমি ঠিক করলাম ইণ্ডিয়া ফিরে যাবো। তোমাদের সেটা ফোনে জানালাম। এই ডঃ ব্যানার্জীর মেয়েই মুক্তা, মপি মা।
মুমুয়ী দেবীর ঘরে এখন এতোটা নিস্তব্ধতা যে একটা পিন পড়লেও শব্দ শোনা যায়। নীরবতা ভেঙে মুমুয়ী দেবী অশোকবাবুকে বললেন -- পুরোহিত ডেকে তাড়াতাড়ি একটা বিয়ের দিন ঠিক করো। আমি পাপাইয়ের বিয়ে দেবো।
এটা শুনে অশোকবাবু বললেন -- কী বলছিস তুমি মুমুয়ী! সব শুনে পাপাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও তুমি আবার ওর বিয়ে দেবে?
* তোমরা আমায় যতোটা খারাপ ভাবছো আমি অতটা খারাপ নই।
মুক্তার সাথে পাপাইয়ের আবার বিয়ে হবে শাল্মীতে।
এটা শুনে অশোকবাবু, আয়ুশ দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
ভাবিনি।
* তুমি ভুলে যাচ্ছো, পাপাই আর মুক্তা বিয়ে করেছে ডঃ ব্যানার্জীর কথা রাখতে। ওরা কেউ কাউকে চেনে অবধি না, কোনোদিন দেখেনি। এই বিয়েতে কি ওরা সুখী হবে?
অশোকবাবু বললেন -- সে উত্তর আমারো জানা নেই। তবে সময় একদিন নিশ্চয় এর জবাব দেবে। আমরা শুধু ওদের আশীর্বাদ করতে পারি।
* ঠিকই বলেছো তুমি। এছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে মুমুয়ী দেবী বললেন -- তুমি সব দেখো ঠাকুর। সব দেখো।
অশোকবাবু মজা করে বললেন -- যে সংসারে তোমার মত গৃহকর্ত্রী আছে সে সংসারের খেয়াল ভগবান না রাখলেও চলবে।
* দুর.... তোমার সব কিছুতেই ইয়ারকি!! চলো আমি যাই আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। অনেক কাজ আছে।
তারপর একবার অশোকবাবুর দিকে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন।
এটা দেখে অশোকবাবু মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
