# কৌশিক স্যারের মতো কেউ যদি এভাবে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, ফোনেও ধরা না যায়, তবে সেই পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এসব অহেতুক ভাবনাতেই ডুবে ছিলেন রূপালী যে সবের একটার ও উত্তর তার কাছে ছিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। থামতে না থামতেই হঠাৎ কানে ভেসে এলো বাইরে থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দ। তিনি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। মাঠের দিকে চোখ রাখতেই দেখলেন ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করছে। সকলের চেহারায় আতঙ্ক। কেউ কাউকে কিছু বলছে না, শুধু দৌড়াচ্ছে আর পিছন ফিরে উপরে তাকাচ্ছে।
রূপালী কবির ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না এমন অস্থিরতা কী কারণে। ঠিক তখনই টেবিলের ওপর রাখা ফোন বেজে উঠলো। টেলিফোন, ফোন! একের পর এক বেজে উঠলো উনার।
বিশ্ববিদ্যালয়টা হঠাৎ করে নিস্তব্ধতা ছেড়ে এক বিশৃঙ্খলার দিকে হাঁটা শুরু করেছে। রূপালী একটা ফোন তুলে কল রিসিভ করলেন। ধ্বক ধ্বক করা বুক নিয়ে বিপরীত পাশের কণ্ঠের জন্য অপেক্ষা করলেন তিনি।
"ম্যাডাম! বাইরে দেখছেন? "
ধীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন রূপালী,
"জ্বি দেখেছি। কি হচ্ছে এসব? স্টুডেন্টরা কেনো এভাবে দৌড়াচ্ছে??"
"আমাদের বিল্ডিংয়ের ছাদে একজন দানব এসেছে। দেখতে কি যে ভয়ঙ্কর। যাকে সামনে পাচ্ছে কি যেন করছে সাথে সাথেই সামনের মানুষটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। আমি তো ভয়ে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে বসে আছি।"
ফিসফিসিয়ে বললো লোকটি।
রূপালী চিন্তিত গলায় বললেন,
"ঠিক আছে দেখছি আমি।"
রূপালী দ্রুত ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরোতেই হাতে মুখে ইশারা করতে লাগলেন যাতে শিক্ষার্থীরা ভেতরে ফিরে যায়। তাদের নিরাপদে রাখার দায়িত্ব ই তো সকলের। অন্য শিক্ষকেরাও এই কর্মে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাঁচিয়ে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করছে। অনেকে প্রবেশ করতে গিয়েও লুটিয়ে পড়ছে সামনে। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকজনের অবচেতন দেহ। দানবের আক্রমণে জর্জরিত তারা। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। সাদা ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা দ্রুত কাজ করতে চাইছে। কিন্তু দানবের ভয়ে এগিয়ে আসতে পারছে না যদি তারাও এই দানবের আঘাত পেয়ে বসে তখন? সাংবাদিকরাও ছুটে এসেছে ক্যামেরা হাতে। লাইভ চলছে টিভিতে।
রূপালী আর দেরি না করে নিজেই মাঠে নেমে এলেন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন সে। কে এই দানব? কেমন সেই ভিনদেহী প্রাণী? জিজ্ঞাসার ভার বুকে নিয়ে দেখার জন্য মাঠে হাঁটতে লাগলেন রূপালী। বারবার মুখ তুলে দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন দানবটিকে চোখের নাগাল পাওয়া যায় কিনা! হঠাৎ উপরের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো তার। দূরে বিল্ডিংয়ের ছাদের দিকে ধোঁয়ায় ঢাকা এক পুরুষাকৃতির অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মুখ এবং দেহ সব ঢেকে আছে ঘন কালো ধোঁয়ার চাদরে। তবু মাঝেমধ্যে সেই ধোঁয়ার ফাঁক গলে ঝলসে ওঠে নীল আলো যা মুহূর্তেই শিরা-উপশিরায় ঠান্ডা স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
রূপালী স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন। চেনা চেনা মনে হচ্ছিল তার। এই চোখগুলো সে আগেও দেখেছিল এমন মনে হচ্ছিল। আচমকাই সেই চোখ ঝলসে উঠলো। দূর থেকেই দানবটি তার হাত রূপালীর দিকে ইঙ্গিত করলো এবং সাথে সাথেই শক্তি খেয়ে নিলো। রূপালী কবির বিস্ময়ের সাথে চোখ বড় করলেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। কৌশিকের দেহ বিল্ডিংয়ের ছাদেই অবস্থান করছে। চোখ চারপাশে ঘুরঘুর করছে। কৌশিক আবারো নিজের উপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সকালে উঠেই নিজেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে আবিষ্কার করে। তারপর থেকেই সে কি করছে সে নিজেই জানে না। তার শরীরের সমগ্র স্থান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তার শরীর শুধু শক্তি চাইছে। প্রচুর শক্তি পেয়েও থামছে না, চাইছে তো চাইছেই।
হঠাৎ নিচে থেকে একজনের কণ্ঠ শোনা গেলো। কৌশিক দ্রুত এগিয়ে এসে নিচে তাকালো। অনন্যাকে দেখা গেলো।
অনন্যা চিৎকার করে বললো,
"কায়েরীথ ! এখানেই থামো। আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালিও না।"
কৌশিক হাসলো। হাতের ইশারায় অনন্যা কে আঘাত করতে চাইলো। কিন্তু তার আগেই অনন্যা দৌড়ে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে গেল। তার ছুটে যাওয়া ছিলো খুব দ্রুত যে কৌশিক বুঝতেই পারলো না কখন মেয়েটা ভেতরে ঢুকে গেল। কৌশিক আবারো পাত্তা না দিয়ে অন্য দিকে মনোযোগ দিলো। অন্য মানুষ খুঁজতে লাগলো। এক হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। অন্য হাত বাড়িয়ে সে চোখ ঘুরাতে লাগল। আশেপাশের বিল্ডিংগুলোয় ও মনোযোগ দিলো সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা নিরীক্ষণ করলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীল চক্ষুর অন্তরালে সামনের বিল্ডিংয়ে একটা ছেলেকে দৌড়ে যেতে দেখতে পেলো সে। সাথে সাথেই কৌশিক নিজের হাত উঁচু করলো। কিন্তু তার আগেই অনন্যা এসে পড়লো আর প্রিন্স শব্দটা উচ্চারণ করলো। কৌশিকের কর্ণে সেই শব্দ পৌঁছাতেই সে থেমে যায়, স্তব্ধ হয়ে যায়। মুখ ঘুরিয়ে অনন্যার দিকে তাকায়।
কৌশিক অনন্যার মুখ থেকে প্রিন্স শব্দটা শুনে শান্ত হয়ে গেলো। কৌশিকের বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা আচমকাই আওয়াজ করতে লাগলো। তার নীল দৃষ্টি ধীরে ধীরে নিভে যেতে লাগলো। অনন্যাও সেই সুযোগে এগিয়ে এলো। এগিয়ে এসে কৌশিকের গালে হাত রাখলো সে। মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকালো সামনের পুরুষটির দিকে। ধীর কণ্ঠে বললো,
"প্রিন্স! শান্ত হন। কি করছেন আপনি? এমনটা তো আপনি ছিলেন না। তাহলে কেনো এমন করছেন? কেনো মানুষদের শেষ করছেন? আমি জানি আপনি একজন ভালো পুরুষ। অন্তত আমার জন্য তো আপনি একশ গুণ ভালো, প্রিন্স। একবার ভাবুন আপনার এই রূপ দেখে আমার শরীরে কত বড় আঘাত লেগেছে! আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু জানেন বেঁচে থেকেও আমি