গল্প: ছেঁড়া জুতার গান
✍️ লেখক: মোঃ জনি
এক
রেললাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে এক কিশোর। নাম রাজু। বয়স হয়তো তেরো-চৌদ্দ। তার পরনে ছেঁড়া স্কুলড্রেস, পায়ে ফাটা একজোড়া পুরোনো জুতো—ডান পায়ের সামনের অংশ ফেটে গেছে, ভেতর থেকে দেখা যায় মোজা না পরা পায়ের আঙুল।
তবুও তার মুখে হাসি। হাতে একটা পুরোনো খাতা আর টিউশনির ব্যাগ।
সে পড়ে শহরের এক সরকারি স্কুলে। স্কুলে যেতে হয় হেঁটে হেঁটে, প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা। জুতো ছেঁড়া হলেও সে ভাবে—“যতদিন না পা রক্ত দেয়, ততদিন তো এগোনো যায়!”
দুই
রাজুর বাবা রিকশাওয়ালা। মা গৃহকর্মী। সংসারে অভাব, কিন্তু মানসিকতায় কোনো দারিদ্র্য নেই।
একদিন স্কুলে শিক্ষক বললেন, “আগামীকাল বিজ্ঞান প্রদর্শনী। যার যার প্রকল্প তৈরি করে আনবে।”
সবাই হৈ হৈ করে বলল—“আমি রোবট বানাব!”
“আমি সৌরচালিত গাড়ি বানাব!”
রাজু চুপ করে রইল। তার কাছে নেই খেলনা গাড়ি, নেই ব্যাটারি, নেই চার্জার। তবু সে রাতে ঘুমোলো না।
ভাঙা ঘড়ির যন্ত্র, বুড়ো টর্চলাইট, একটুখানি তার—সব জোড়াতালি দিয়ে বানিয়ে ফেলল একটা ছোট্ট বাতি—যা দিন হলে নিভে যায়, আর রাত হলে জ্বলে ওঠে।
তিন
পরদিন স্কুলে বিজ্ঞানের মেলায় রাজুর প্রকল্প দেখে শিক্ষক থমকে গেলেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এটা কোথা থেকে শিখলে?”
রাজু মাথা নিচু করে বলল, “ইউটিউবে স্যার। ভাইয়া ফোনে দেখতে দিত মাঝে মাঝে। তখন দেখে শিখেছিলাম।”
শিক্ষক হাসলেন, বললেন, “তুমি জানো তুমি কী বানালে? এটা একটা 'লাইট-সেন্সর' টেকনোলজি!”
সবাই অবাক। ছেঁড়া জুতো, পুরোনো ব্যাগ—তার ভেতর এমন আলো?
চার
রাজুর প্রকল্প প্রথম স্থান পেল। জেলা পর্যায়ে ডাক এল। সেখানে এক ইঞ্জিনিয়ার প্রশ্ন করলেন, “তুমি ভবিষ্যতে কী হতে চাও?”
রাজু উত্তর দিল, “আমি আলো দিতে চাই—যেখানে যেই ঘরটায় রাতে এখনো আলো জ্বলে না, সেখানে একটা ছোট্ট বাতি জ্বলুক আমার কারণে।”
পাঁচ
কয়েক বছর পর, রাজুর নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালু হয়—“ছেঁড়া জুতার আলো।”
যারা স্কুলে যেতে পারে না, যারা বিজ্ঞান বুঝতে চায়, অথচ সামর্থ্য নেই—তাদের হাতে রাজু পৌঁছে দেয় একটা নতুন সকাল।
সে এখনো আগের মতোই হাঁটে—কিন্তু নতুন জুতোয় নয়, পুরোনো ছেঁড়া জুতার স্মৃতি সঙ্গে করে।
কারণ, রাজু জানে, ঠিক সেই ছেঁড়া জুতার ফাঁক দিয়ে একদিন পৃথিবীর আলো ঢুকেছিল।
সমাপ্ত।গল্প: মোহনের ছাতা
✍️ লেখক: ChatGPT
এক
মোহনের বয়স পঁচিশ, কিন্তু চেহারা দেখে কেউ বলবে সাঁইত্রিশ। অফিসে সে ‘নির্ভরযোগ্য’ — মানে সব ঝামেলা ওর ঘাড়েই পড়ে।
সে থাকে মিরপুরে, কাজ করে মতিঝিলে। ভোরে উঠে অফিস, সন্ধ্যায় ফেরা। আর তার জীবনের সবচাইতে গর্বের জিনিস?
একটা কালো ছাতা।
না, এই ছাতায় কোনো বিশেষত্ব নেই। প্লাস্টিকের হাতল, কটনের কাপড়, এক পাশে টিউবের প্যাঁচ। কিন্তু মোহনের কাছে সেটি তার প্রাণের চেয়েও দামী। কারণ, এই ছাতাটা তাকে দিয়েছিলেন তার বাবা, যিনি বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন।
দুই
একদিন আষাঢ়ের দুপুরে, বৃষ্টি ঝরছে পিয়ানো বাজানোর মতো। মোহন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ছাতা মেলে দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন ছাতা শেয়ার করার কাউকে। কারণ এই ছাতার নিচে জায়গা হয় ঠিক দু’জনের — সে নিজে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছে বহুবার।
ঠিক তখন এক নারী সহকর্মী, নাম শর্মিলা, ছুটে এলেন ভিজতে ভিজতে।
"উফ্! মোহন, একটুও জায়গা হবে?"
মোহন ইতস্তত করে বলল, "ছাতাটা ছোট… কিন্তু আপনি চাইলে…"
"আহা! জায়গা না থাকলে থাক না, ভিজে তো গেছি এমনিই। তবু একসঙ্গে গেলে কথা বলার সুযোগ হবে!"
বৃষ্টি পড়তে লাগল আরও ঘন হয়ে। ছাতার নিচে তারা হাঁটলেন—শুধু দেড় কিলোমিটার, কিন্তু গল্প হলো অনেকখানি।
তিন
সেইদিন থেকে নিয়ম হয়ে গেল—বৃষ্টি পড়লে মোহনের ছাতার নিচে জায়গা থাকবেই। অফিসের সবাই বলাবলি করত, “দেখছো তো, ছাতা দিয়ে প্রেম জমে কেমন!”
কিন্তু মোহন কিছুতেই নিজের মুখ খোলেন না। তার ভয় — ছাতা দিয়ে যার প্রেম শুরু, ছাতা হারিয়ে গেলে যদি সে-ও হারিয়ে যায়?
চার
হঠাৎ একদিন, এক রাতে অফিস থেকে বেরিয়ে মোহন বুঝতে পারলেন — ছাতাটা নেই! সারাদিন ভেবেছেন, জানি কোথায় রেখেছেন না রেখেছেন।
পরদিন অফিসে গিয়ে খুঁজলেন—না, কেউ দেখেনি। মাথায় হাত। বুক ধড়ফড়।
হঠাৎ শর্মিলা এগিয়ে এসে বললেন,
"তোমার ছাতাটা… কাল রাতে আমার ব্যাগে ঢুকে গেছে। আমি পরে দেখি। খুব সুন্দর ছাতা তো! এটা কি তোমার বাবার?"
মোহনের চোখ ভিজে এল। মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ।"
শর্মিলা বলল, "তোমার মতো ছাতা আমি আগে কখনও দেখিনি। তুমি কি জানো, এর নিচে দাঁড়ালে মানুষ একটুখানি নিরাপদ বোধ করে?"
পাঁচ
এরপর থেকে মোহন আর ছাতাটা নিয়ে অত চিন্তা করেন না। কারণ, তিনি বুঝেছেন—জিনিস হারালেও সম্পর্ক টেকে। ছাতার কাপড় হয়তো ছিঁড়তে পারে, কিন্তু যে ছায়া সে দেয়, তা থেকে তৈরি হয় এমন কিছু, যা আরও গভীর।
শেষে দেখা যায়, তারা দু’জনেই এখনো বৃষ্টির দিনে হাঁটেন একই ছাতার নিচে।
কিন্তু তখন মোহন আর বলে না, "এইটা বাবার ছাতা।"
সে বলে, "এইটা আমাদের ছাতা।"
সমাপ্ত।