র এসে লাগল নাকে! এই স্মৃতিই তো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। তার বুকে জমে ছিলো ক্ষতের মতন। আজ কতটা শীতল লাগছে। বুকটা ঠান্ডা লাগছে। প্রাণ ফিরে এসেছে অনুভব হচ্ছে।
"আম্মারে, আম্মা, তুই এলি মা আমার? তুই অবশেষে বাবার বুকে এলিরে, মা। মা গো, কী যন্ত্রণায় পুড়ছিলাম এতগুলো বছর! অবশেষে এলি মা। বাপের পরাণ ঠান্ডা করলি, মা। বাপের পরাণ ঠান্ডা করলি।" বাবাটা বাচ্চাদের মতন বুলি আউড়িয়ে কাঁদছেন কেমন করে।
চাঁদনীও কি আটকাতে পারে চোখের জল? থামাতে পারে দূরত্ব মিটে যাওয়ার এই আনন্দের অশ্রুকে?
বাবাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রইল চুপ করে। রোজা সওদাগর এসে মেয়ের পিঠের উপর মাথা রাখলেন। মহিলাও কাঁদছেন হাউমাউ করে।
চাঁদনী মা আর বাবাকে জাপ্টে ধরে আছে। পাহাড় সে কীভাবে দেখতে যেতো এই স্বর্গগুলোকে না দেখে? মরে গেলে আফসোস থাকতো না? তাই তো শেষ মুহূর্তে ছুটে এলো দুনিয়ার সর্ব উঁচু বাবা নামক হিমালয়ের বুকে। মা নামক বৃক্ষের ছায়ায়। এরচেয়ে বড়ো পাহাড় আর হয় না-কি!
*
অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে রুমটিতে ভাপসা একটি গন্ধ। আবছায়া ভাব। মনে হয় দুঃখের অশরীরীরা নৃত্য করছে হাত তুলে। সেই আবছায়ার সাথে হু হু করে মিশে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসেরা।
বনফুল ভাইয়ের কাছে আবদার করে বসল। মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বলল,
"আমারে বাড়ি নিয়ে চলো, ভাইয়া। এখানে যে মন টিকে না।"
বাহার ভাই বোনের হাত ধরে চুপ করে থাকেন। বোনকে এখান থেকে নেওয়ার জন্য এখানের দুই মাসের টাকা পরিশোধ করতে হবে। মোট সাঁইত্রিশ হাজার টাকার প্রয়োজন। অথচ তার কাছে সবে আছে আঠারো হাজার। তমসার টিউশনিটা না ছাড়লে হয়তো টাকাগুলো ম্যানেজ করা যেত। কিন্তু সেটাও ছেড়ে দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে আবেদনই করা যাচ্ছে কেবল। চাকরি আর হচ্ছে না। জেল ফেরত আসামীকে চাকরি দিতে চায় কেই-বা? সে যতই নির্দোষ প্রমাণিত হোক।
"ও ভাইয়া, কবে নিয়ে যাবে আমাকে।"
আবুঝ বাচ্চাটির মতন প্রশ্ন। বাহার ভাই উত্তর দিতে গিয়ে গুটিয়ে যান। কী বলবেন? বোনের কি আর বোঝার মতন বোধ আছে? বুঝবে কি এই অর্থ সংকটের কথা?
বাহার ভাইয়ের এই চিন্তায় মগ্ন হওয়ার মুহূর্তে উপস্থিত হলো তুহিন। হাসিখুশি তার মুখটি। বনফুলের জন্য একগুচ্ছ গোলাপ ফুলের তোড়া এনেছে। উজ্জ্বল, চনমনে কণ্ঠে বলল, "এত সুন্দর রুমটি অন্ধকার কেন শুনি?"
তুহিনকে দেখেই বনফুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বাহার ভাইও খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,
"তুমি এখানে?"
তুহিন এগিয়ে এলো। ফুলের তোড়াটি এগিয়ে দিলো বনফুলের দিকে। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
"হ্যাঁ। আজ না বনফুলের ছুটি?"
তুহিনের কথায় চমকে উঠলেন বাহার ভাই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, "ছুটি? কীসের ছুটি? কে বলেছে?"
তুহিনের এবার খটকা লাগলে। সামান্য ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, "কেন? এখান থেকেই তো আমার ফোনে কল গেলো। বলল, আজ বনফুলের ছুটি।"
বাহার ভাই অতি আশ্চর্য হলেন। ছুটে গেলেন ম্যানেজমেন্টের কাছে এবং জানলেন তার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বনফুলকেও এখন বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।
ম্যানেজমেন্টের লোক বাহার ভাইয়ের হাতে একটি চিরকুটও ধরিয়ে দিলেন। যে টাকা পরিশোধ করেছেন সে নাকি এই চিরকুটটি দিয়ে দিয়েছে।
বাহার ভাই চিরকুট মেলে দেখলেন। ছোটো একটি লাইন। লাল কালিতে লিখা আছে— এতটুকু ঋণ থাকুক।
বাহার ভাই অবাক হয়ে লিখাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই লিখাটি তার পরিচিত বড়ো। চেনা চেনা লিখা। কে ন ঋণী করে দিয়ে গেলো তাকে? কী এত দায় সেই অপরিচিত মানুষটির?
*
বিয়ে বাড়িতে আনন্দে জড়িয়ে আছে কোণায় কোণায়। চাঁদনীর আগমন আনন্দকে দ্বিগুণ করে দিয়েছে যেন। চিত্রা কেবল ঘুরে-ফিরে চাঁদনী আপার কাছে যাচ্ছে। আপার গাল ধরে কেবল বলছে,
"আমার বিশ্বাস হয়না, তোমায় ধরতে পারছি আবার।"
চাঁদনী যেহেতু অহির রুমেই, অহির সাজগোছ করাচ্ছে নিজের হাতে সেহেতু চিত্রার কথা অহির কান অব্দিও পৌঁছাচ্ছে। আর অহি ততবারই মুচকি হাসছে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলছে,
"ঠিক। আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না।"
অহি আপার সম্মতি পেতেই চিত্রা যেন আরেকটু উৎসাহী হয়ে উঠে। এরপর আরেকটু কৌতূহল নিয়ে বলে,
"তুমি সুন্দরও হয়ে গিয়েছো, আপা।"
অহি এবারেও সম্মতি জানায়। দুই বোনের পাগলামো দেখে চাঁদনী হেসে কুটিকুটি হয়।
বাড়িতে খুশি তখন গমগমে। সকলের আঙিনা বেয়েই যেন সদ্য খুশি ধরা দিচ্ছে। কেবল খুশিতে ভাঁটা পড়েছে একটি ঘরে। সেই ঘরটি অহির বাবা-মায়ের। ঘরটির ভেতরে গুমোট নীরবতা। বাহিরের হৈচৈ কেমন ঝনঝনিয়ে বাজে কেবল।
অহির মা- অবনী বেগম স্বামীর পাঞ্জাবি, পায়জামা আলমারি থেকে নামিয়ে নামিয়ে রাখছেন।
সবশেষে স্বামীকে বললেন, "তৈরি হও। ছেলের বাড়ির সকলে এলো বলে।"
আমজাদ সওদাগরের মুখ চোখ শুকনো। স্ত্রীর কথাকে তেমন গা না করে বললেন, "তুমি যাও রুম থেকে। আমি একা থাকতে চাই।"
"আমি তো তোমার কোলে উঠে বসে থাকিনি। না তোমার আগেপিছে ছুট