#দীর্ঘশ্বাস কিন্তু চাঁদনী তা বের হতে দিলো না। বুকের ভেতর জোর করে চেপে রেখে বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
"আমি এখানে এটা জেনেই এসেছি যে আমার কাছের মানুষদের দীর্ঘদিন দেখা হবে না। তাই বাচ্চা বাচ্চা মন খারাপ আমার হয় না।"
"চা খাবেন, ইন্দুবালা?"
"তুমি আমার চেয়ে চার বছরের ছোটো, মৃন্ময়। তাই অন্তত নাম ধরে না ডেকে আপু ডেকো।"
"আপনার নাম তো চাঁদনী! ইন্দুবালা কবে থেকে হলো?"
চাঁদনী এবার থতমত খেলো। ইশ্ সত্যিই তো! ছেলেটা কেমন করে আজও তাকে প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করলো!
চাঁদনীকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো মৃন্ময়। যেন কথার খেলায় জিতে গিয়ে বিরাট কিছু অর্জন করে ফেলেছে। চাঁদনী কতক্ষণ চুপ থেকে নিজের ভ্যাবাচেকা ভাব কাটিয়ে উঠে বলল,
"কোনো কাজ আছে এখানে, মৃন্ময়? নয়তো চলে যাও। এতক্ষণ কেউ এখানে বসে থাকলে ব্যাপারটা কেমন দেখাচ্ছে।"
"না কাজ নেই। ব্যথা করছিলো তো তাই ভাবলাম একটু এসে বসি।"
চাঁদনী ঠিক বুঝলো না মৃন্ময় কী ব্যথা করার কথা বলল! না-কি শুনতে পেলো না! তাই আবার জিজ্ঞেস করল,
"কী ব্যথা করছে? পা?"
মৃন্ময় বেশ স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো, "না তো। মন ব্যথা করছিলো। আড়াই বছর আপনাকে না দেখতে দেখতে আমার মনটার ভীষণ ব্যথা হয়েছে জানেন?"
চাঁদনী এবার গাঢ় চোখে তাকালো। মৃন্ময়ের ঠোঁটে চাপা হাসিটা তখনও দৃশ্যমান। মেয়েটার মনে মনে কিছুটা রাগ হলো। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, আড়াই বছর পর বুক ব্যথার কথা মনে পড়লো কেন ছেলেটার। কিন্তু জিজ্ঞেস আর করলো না। জিজ্ঞেস করা মানেই যে উস্কানি দেওয়া, ছেলেটাকে বুঝানো যে সে খুব আগ্রহী ছেলেটাকে নিয়ে। অথচ চাঁদনী তো এটা বুঝাতে চায় না! তাই নিজের ভাবনা নিজের ভেতরই চাপা রাখলো। চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিলো আলগোছে। স্বচ্ছ কাঁচের জানালাটা দিয়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে রাস্তাটা। চাঁদনী সেদিকে দৃষ্টি দিলো। বিড়বিড় করে বলল,
"তোমার বুক ব্যথা কমলে চলে যেও, মৃন্ময়। বার বার অন্য কারো অস্বস্তি হইও না।"
মৃন্ময়ের চাপা হাসিটা দমে গেলো। হতাশ শ্বাসের স্রোতে ভরে গেলো বুকের আঙিনা। লজ্জায় মাথাটা আরেকটু নামিয়ে নিলো।
•
সওদাগর বাড়িতে যেন বহু বহু দিন পর আনন্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। হাসছে প্রাচীর ঘেঁষা আঙিনা, কাঠের বাক্সটাও। ছাদের ফুলগুলোতে আজ বোধহয় ভ্রমরও এসেছে। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে আনন্দ। শুধু কমতি বাড়ির বড়ো মেয়েটার। ও এলেই যেন ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যেতো।
অহি আসার সুবাদে বাড়িতে হরেক রকমের খাবার রান্না হয়েছে। খাবার সাজাতে ব্যস্ত বাড়ির বউরা। খাবার টেবিলে পা দুলিয়ে গল্প করছে বড়োরা। পোলাও আনতেই চিত্রা বহু পুরোনো অষ্টাদশীর মতন লাফ দিয়ে বললো,
"ছোটো মা, আমায় আগে দাও। পেটে সয় না।"
অবনী বেগম হেসে দিলেন। সত্যি সত্যি চিত্রার কাছেই আগে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পোলাও দিলেন প্লেটে। নুরুল সওদাগর নিজের পাশের বেগুনি রাখা প্লেটটা থেকে মেয়ের প্লেটে বেগুনি দিলেন। সবসময়ের মতনই তিনি রইলেল গুরুগম্ভীর। তুহিন ফোঁড়ন কেটে বলল,
"আব্বু, আমাদেরও বেগুনি দেন।"
মিটমিটিয়ে হাসলো সকলে। নুরুল সওদাগর যথারীতি মুখ গম্ভীর করেই জবাব দিলেন, "নিজে নিয়ে নাও।"
তুহিন এবার হেসে দিলো। বোনকে চোখ টিপ দিয়ে বলল, "আজকাল চিত্রার ভাগ্যেই সব ভালোবাসা পড়েছে। আমাদের তো কেউ ভালোবাসবে দূর, বেগুনিও দেয় না।"
কথা শেষ করে সমস্বরে হেসে উঠলো সকলে। চিত্রাও হাসলো তার তালে অথচ চোখের কোণায় জল তখনও থৈ থৈ করছে। তার কত বছরের স্বাধ ছিলো বাবা তাকে এরকম যত্ন করবে! অবশেষে সেই স্বাধ পূরণ হচ্ছে। তার আনন্দ হবে না? আর আনন্দ হলে তো একটু চোখে জল আসবেই।
চিত্রার দিকে তাকিয়ে নুরুল সওদাগর বুক ভরে শ্বাস নিলেন। মেয়েকে যে কবে এতটা ভালোবেসে বুকের মাঝে পুষেছেন তার ঠিক খেয়াল ছিলো না। মেয়েকে যে এতটা তিনি ভালোবাসেন সেটাই অনুভব করেছেন বড্ড দেরিতে। মেয়েটা যখন তার পাগল পাগল হয়ে উঠেছিলো, মৃত্যুর জন্য ছিলো মরিয়া তখন তিনি বুঝেছেন মেয়েকে ছাড়া তিনি এক বেলাও ভালো থাকবে পারবেন না। সম্ভব না।
খাওয়া দাওয়া শেষে সোফায় বেশ আয়েস করে বসল অহি। চিত্রা আগে থেকেই বসা ছিলো বিধায় গায়ে