কিন্তু তার আগেই সেই বিদায় দিন, সেই প্রত্যাহারের সন্ধ্যা তার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। কী সেই বিরহ বেদনা, কী সেই হাহাকার! লাল শাড়িটায় ধূলো মেখে যা-তা অবস্থা! মৃত্যু নিকট থেকে দেখা সেই দিনগুলো? এগুলো এত দ্রুত ভুলে যাবে সে? খারাপ স্মৃতি জন্মদাগের মতন। কখনো মুছে না।
চিত্রার হাসি মিলিয়ে গেলো মিনিট পেরুতেই। হাঁসফাঁস করে উঠল অন্তরটা। সে তপ্ত শ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে ঘরের দিকে ফিরতে নিলো। তার আগেই বাহার ভাইয়ের উৎকণ্ঠা মাখানো ডাক পড়ল,
“চলে যাচ্ছো যে! আজ গান ভালো লাগেনি? পুরোটা শুনবে না?”
চিত্রা ফিরে তাকালো না। তবে চলেও গেল না। যেতে পারল না। সে যে বাহার ভাই নয়। সে যে এখনো মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মতন নিষ্ঠুর হয়নি।
“রঙ্গনা….”
চিত্রা ঘুরে দাঁড়ালো। বাহার ভাই ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে বলে একদম মুখোমুখি মনে হচ্ছে। কেবল তাদের পথে বাঁধাটা বারান্দার লোহার বাঁধটুকু। যেমন করে বাঁধা হয়েছিল সেই বিদায়ের সন্ধ্যাটা।
“কথা বলবে না, রঙ্গনা?”
“চিত্রা আমার নাম। ভুল করছেন।” চিত্রার শক্ত-পোক্ত জবাব। কোথাও কোনো নরম তুলতুলে আবেগটুকুর দেখা নেই যেন। সবটুকু ভেঙেচুরে নিঃশেষ।
বাহার ভাই প্রচন্ড বিস্ময় ভরা নয়নে তাকাল। ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “ডাকনামটুকুর অধিকার কেঁড়ে নিও না। তাহলে নামটুকু মরে যাবে।”
“হাহ্! নাম মরে যাওয়া নিয়ে এত চিন্তা? এদিকে মানুষের কবর খুঁড়ে রেখেছেন!”
“অভিমান অনেক?”
“অভিমান! কে আপনি যে অভিমান করবো?” প্রশ্ন যদিও করল কিন্তু মেয়েটা উত্তর জানার প্রয়োজন কিংবা আগ্রহটুকু দেখালো না। হনহনিয়ে চলে গেলো ঘরের ভেতর। বিনা সংকোচে বারান্দার দরজাটুকু আটকে দিল। শব্দ হলো অনেক। শব্দটা যেন সরাসরি বিদ্রুপ করে উঠল। বুঝিয়ে দিলো চিত্রার মনের কাঠিন্যতা কতটুকু।
বাহার তপ্ত শ্বাস ফেলল। গিটারটা রেখে দিল পাশেই। রাখতে গিয়ে ডান হাতের পুরোনো ব্যথা তড়পে উঠল। চোখ-মুখ কুঁচকে গেল সেই ব্যথায়। শার্টের হাতাটুকু একটু উপরে তুলে দেখলো পুরোনো, কালশিটে দাগটা এখনো কতটা উজ্জ্বল।
চিত্রা বারান্দা থেকে ঘরে এসে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিল। বুকে চেপে থাকা দুঃখটা শ্বাসের চাপায় দমিয়ে দিতে চাইলো। সেই মুহূর্তে হনহনিয়ে ঘরে ঢুকলেন মুনিয়া বেগম। মেয়েকে উদভ্রান্তের মতন শ্বাস নিতে দেখে চমকে গেলেন। মেয়ের কষ্ট হচ্ছে ভেবে ছুটে এলেন। তড়িঘড়ি করে বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আতঙ্কিত গলায় শুধালেন,
“কী হয়েছে, মা? কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? শ্বাস নিতে পারছো না? ইনহেলারটা কোথায় রেখেছো?”
পর পর প্রশ্নের তোপে তাজ্জব চিত্রা। সে তো স্বাভাবিক ভাবেই একটু জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো! মায়ের এতটা উদগ্রীব, আতঙ্ক দেখে আফসোসে আফসোসে ভেতরটা গম্ভীর হয়ে গেলো। তার করা অতীতের দিনগুলো স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠল ছবির মতন। অতীতে মানুষ গুলোকে কতটা কষ্ট দিয়েছিল সে, যে আজ মানুষগুলো সামান্যতেই ভড়কে যাচ্ছে! চিত্রার খারাপ লাগল। ডান হাতটা মায়ের মুঠোর মাঝে আলোগোছে ভোরে বলল,
“কিচ্ছু হয়নি, আম্মু। এত উত্তেজিত হইও না।”
মুনিয়া বেগম তাও ঠান্ডা হতে পারলেন না। বার বার জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছিস তো? কষ্ট হলে বল। ইনহেলারটা নে।”
“কোনো কষ্ট হচ্ছে না, আম্মু। ইনহেলার লাগবে না আমার। এই দেখো কী সুন্দর শ্বাস নিতে পারছি।”- কথাটা বলেই দুই-তিন বার বুক ভরে শ্বাস নিল সে। মুনিয়া বেগমের যেন প্রাণ ফিরে এলো। বেশ বড়োসড়ো শ্বাস ফেলে বললেন,
“ভয়ই পেয়ে গিয়ে ছিলাম।”
চিত্রা মা'কে জড়িয়ে ধরল। আলতো কণ্ঠে বলল, “অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি তাই না? আর দিবো না।”
মেয়ের এই আগের, বহু পুরোনো রূপটা দেখে মুনিয়া বেগমের চোখে জল এলো। জাপটে ধরলেন মেয়েকে। মেয়ের পুরোনো মানুষ ফিরেছে বলেই যে পুরোনো রূপ ফিরছে তা মায়ের মন বুঝেন, জানেন। সেই দুঃসময়ের দিনগুলো কতটা ভয়ঙ্কর ছিল তা কি আর ভুলা যায়?
•
বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে আছে অহি। চারপাশের প্রতি তার কোনো ধ্যান নেই। তার ধ্যান তার হাতের বইটি। সেই ধ্যানের সমুদ্রে ডুবে থাকা অহির ধ্যানের স্রোতে ভাঁটা ফেলল দরজার তুমুল টোকা। অহি বিরক্ত হলো। চশমাটা ঠেলে আরেকটু আঁটসাঁট করে লাগালো চোখে। কণ্ঠ খানিকটা উপরে তুলে জিজ্ঞেস করল,
“কে?”
অপর পাশ থেকে নাতাশা বেগমের তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আমি।”
নাতাশা বেগমের জায়গায় যদি ঘরের কাজের খালা হতেন অহির বিরক্তি বোধহয় কিছুটা কম হতো কিন্তু নাতাশা বেগমের কণ্ঠে বিরক্তি কমবে দূরে থাক, হুড়মুড় করে বেড়ে গেলো।
সেই বিরক্তির সর্বোচ্চ সীমা থেকে আবার প্রশ্ন করল,
“কী চাই?”
নাতাশা বেগম মেয়ের একের পর এক প্রশ্নে অসন্তুষ্ট হলেন কিন্তু ঘরে মানুষ আছেন বিধায় কথা কাটাকাটি পর্যায়ে নিয়ে গেলেন না। বরং কোকিলকণ্ঠী সুরে বললেন,
“আম্মু তোমার ফারুক চাচ্চু, চাচী, লিমন ভাই, অধরা ভাবি আসছে। দরজা খোলো। দেখা করবে আসো।”
ঘর ভর্তি মানুষ এসেছে যে তা অহি জানে। জেনেই যে সে দরজা আটকে বসে আছে এটা নাতাশা বেগম জানেন। তবুও তার এমন
Read More
Md Habib Ullah
Slet kommentar
Er du sikker på, at du vil slette denne kommentar?