ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট নিশিতাকে যখন তার স্বামী লাথি মেরে বের করে দিচ্ছিলো আশেপাশের সবাই শুধু তামাশা দেখছিলো। কেউ এগিয়ে আসে নি। নিশিতার শাশুড়ি আর ননদ তো কত বিশ্রি বিশ্রি গালাগালি করছিলো। নিশিতা সেদিন কতটা অসহায় ছিলো সেটা হয়তো কেউ ধারণাও করেনি। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কোথায় যাবে কোথায় কি? বাপের বাড়িতেও তো যাওয়ার মুখ নেই। এমনটা নয় বাবা মা খুব গরিব৷ বরং নিশিতার বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী। পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা মা ত্যাজ্য করে দিয়েছিলেন। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি জানতেন নিশিতার ফ্যামিলি কত ভালো তবে কি এভাবে লাথি মারার সাহস হতো? স্বয়ং অর্নবও তো জানে না।
আজ বাইশ বছর কেটে গেছে। নিশিতার সেইদিনের পেটে থাকা বাচ্চাটা আজ একুশ বছরের। আজ একুশটা বছর কেটে গেলো সেদিনের। নিশিতা বেঁচে নেই৷ বছর পনেরো আগে কার এক্সিডেন্টে মারা গেছেন৷ সেদিন এতবড় বিপদে থাকা নিশিতাকে আর কেউ নয়, বরং নিশিতার পাগল প্রেমিক অয়ন নিজের নিয়ে গেছিলো। অর্নবের সাথে ডিভোর্সটা করিয়ে নিশিতাকে বিয়ে করে নিয়েছিলো। অয়ন সবসময় নিশিতাকে চোখে চোখে রাখতো৷ তবে ভাগ্যক্রমে সেদিন খুব দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তবুও নিজের করে তো পেয়েছে। মেয়েটা কখনোই স্বামীর অধিকার দেয় নি। তাতে কি? এতগুলো বছর তো নিজের কাছে রয়ে গেছিলো।
অন্তিকা আমান নিধি। নিশিতার মেয়ে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে ঢাকার সনামধন্য এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। বাবা অয়ন, দাদী আর ফুপ্পির সাথেই তার জীবন। মা মারা যাওয়ার পর থেকে একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। বিয়ের কথা উঠলেও অয়ন নিষেধ করে দেয় তার মাকে। মেয়েকে তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো উঁড়তে দেখতে চান।
আজ নিধি ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় তার গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে অর্ধেক রাস্তায় আসতেই একজন লোকের সাথে ধাক্কা লাগে৷ লোকটাকে দেখে নিধি চিনে ফেলল। তার বাবা অয়ন তাকে সমস্ত কথা বলেছে। এই লোকটা তারই বাবা অর্নব। ঘৃণা করলো তার এই লোকটাকে। মায়ের কথা মনে পড়লো খুব। আর কান্না পেলো। কিন্তু এরা এখানে কি করছে?
অর্নব শেখের চোখেমুখে বয়সের ছাপ পড়েছে। এমনিতেই খিটখিটে মেজাজে রয়েছে তার ওপর এই মেয়ে তাকে ধাক্কা দিয়েছে। আজকাল কার মেয়েরা মানুষ দেখলেই ইচ্ছে করেই ধাক্কা কেন দেয়। চোখ তুলে তাকাতেই মেয়েটার খুব চেনা চেনা লাগলো উনার। তবুও খিটখিটে মেজাজের থাকায় চেঁচিয়ে বলে উঠল,
'এই বেয়াদব মেয়ে। তোমার সাহস হয় কিভাবে আমাকে ধাক্কা দেওয়ার? তুমি জানো আমি কে?'
ভ্রু কুঁচকালো নিধি। সে ভদ্রভাবেই বলল,
-' আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেই নি।'
অর্নব আরও রাগ দেখালো,
-' ভদ্রতা শেখোনি? আবার বলছ ইচ্ছে করে ধাক্কা দাও নি। বেয়াদব কোথাকার।'
নিধির এই লোকের সাথে কথা বলতেও বাধলো। সে চলে যেতে চাইলো। তবে বাঁধা দিলেন অর্নব শেখ। ধমকে বললেন,
-'এই বেয়াদবের বাচ্চা। তোর বাবা মা তোকে ভদ্রতা শেখায় নি? আমি চাইলে তোকে এখনই জ্যান্ত পুতে দিতে পারবো।'
কোন বাবার ব্যবহার এমন হতে পারে জানা নেই নিধির। অয়ন মানুষটা নিজের বাবা না হলেও ছোট থেকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। নিধি এবারও ভদ্রভাবেই বলল,
-'আমি তো বলছিই আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেই নি। এতো সিনক্রিয়েটের কি আছে? তবুও বলছি দুঃখিত। যেতে দিন আমায়।'
এই বলে নিধি চলে যেতে নিলে তার সামনে এসে এক মেয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটা তারই সমবয়সী হবে হয়তো। কিন্তু চিনতে পারলো না কে এই মেয়ে। মেয়েটা এসে ন্যাকা স্বরে বলে উঠল,
-'হোয়াট হ্যাপেন পাপা? এই মেয়েটা কে?'
কোথাও একটা আঘাত লাগলো নিধির। এই লোক তাহলে আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটা তার সমবয়সী। নিশ্চয়ই পরকীয়া করতেন। ঘৃণায় এবার থু থু ফেলল পাশের ড্রেনে। এদিকে মেয়ের কথায় অর্নব শেখ বলে উঠলেন,
-'আরে এক বেয়াদব মেয়ে। আমাকে নানা কথা শোনাচ্ছে। ইচ্ছে তো করছে একে চড় মারি।'
মেয়েটা এবার নিধির দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে বলল,
-'তোমার মা বাবা তোমাকে কিছু শিক্ষা দেয় নি?'
রেগে গেলো নিধি। ক্রুদ্ধ আওয়াজে বলল,
-'আমার বাবা মা আমাকে সবকিছুই শেখিয়েছেন। যেটা হয়তো তোমার বাবা নিজে পরিবার থেকে আয়ত্ত করতে পারেন নি।'
এই বলেই সামনে হাঁটা ধরলো। বডিগার্ডরা তখন কোথা থেকে যেনো এলো। সাথে মজনু কাকাও আছে। মজনু কাকা বলে উঠলেন,
-'তুমি একা কেন চলে আসছিলে মা? আমরা তো গাড়িটা ঠিক করছিলামই।'
নিধি কিছু বলতে যাবে এর আগেই তার হাত কেউ ধরে তাকে পেছনে ঘুরিয়ে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো।
#চলবে
#তুমি_ছিলে_বলে
#পর্ব_১
#নুজহাত_মুন