ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে যাঁরা হাদিস প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল ত্যাগ, শিক্ষা, ও আত্মনিবেদনের অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ আমরা তাঁর জীবনের একটি ছোট কিন্তু গভীর শিক্ষা-বহুল ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবো—তিনি কীভাবে একবার সদকা দিলেন, এবং তা কীভাবে তাঁর ঈমান ও আমলকে আরও দৃঢ় করল।
আবু হুরায়রা (রা.) এর পরিচয়
আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন ইয়েমেনের দাওস গোত্রের একজন সদস্য। তাঁর মূল নাম ছিল আবদুর রহমান ইবনে সাখর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংস্পর্শে এসে তিনি ইসলামের আলোকে আলোকিত হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত গরিব; অধিকাংশ সময় অনাহারে দিন কাটাতেন। কিন্তু তাঁর ভেতরে ছিল অশেষ ভালোবাসা রাসূল (সা.) এর প্রতি এবং হাদিস সংগ্রহের প্রতি গভীর আগ্রহ।
ঘটনার সূচনা
একদিনের কথা। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি হাদিস আবু হুরায়রা (রা.) এর অন্তরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। হাদিসটি ছিল এমন—
“যে ব্যক্তি এক খেজুর পরিমাণও হালাল উপার্জন থেকে সদকা দেয়, আল্লাহ তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন এবং তা যত্ন করে বড় করেন, যতক্ষণ না তা পাহাড়সম হয়ে যায়।”
(সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)
এই হাদিস শুনে আবু হুরায়রার অন্তর ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি ভাবলেন—“আমার তো কিছুই নেই। কিন্তু কিছু না কিছু দিয়ে হলেও তো এই সওয়াব অর্জন করা উচিত।”
খেজুরের সন্ধান
আবু হুরায়রা (রা.) নিজের গৃহে ফিরে গিয়ে তাঁর সম্পদের হিসাব করলেন। তিনি যা পেলেন তা ছিল মাত্র তিনটি খেজুর। এটাই ছিল তাঁর সবটুকু খাদ্যভাণ্ডার। তাঁর সামনে এখন ছিল দুটি পথ—এই খেজুর নিজে খেয়ে ক্ষুধা মেটানো, কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তা সদকা করা।
তিনি দ্বিধায় পড়লেন। একদিকে ক্ষুধার জ্বালা, অন্যদিকে সদকার সওয়াব। কিন্তু ঈমান যখন প্রবল হয়, তখন দুনিয়ার চাহিদা তুচ্ছ হয়ে যায়।
তিনি এক খেজুর নিজে খেলেন, এক খেজুর রখলেন পরদিনের জন্য, আর বাকি এক খেজুর সদকা করার ইচ্ছা করলেন।
সদকা প্রদান
সন্ধ্যার সময় আবু হুরায়রা (রা.) বের হলেন। রাস্তার পাশে এক দরিদ্র লোক বসে ছিল, তার মুখে ছিল হতাশার ছাপ। আবু হুরায়রা (রা.) বিনয়ের সাথে তার সামনে গিয়ে বললেন, “ভাই, এটি আমার খুব সামান্য কিছু, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমি এটি আপনাকে দিচ্ছি।”
লোকটি বিস্মিত হয়ে খেজুরটি হাতে নিল। সেই ক্ষুধার্ত লোকটির চোখে পানি চলে এলো। সে কেবল বলল, “আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।”
এই এক খেজুর হয়তো আমাদের কাছে কিছু নয়, কিন্তু আবু হুরায়রা (রা.) জানতেন—আল্লাহর কাছে এর মূল্য পাহাড়সম।
রাতের অলৌকিক ঘটনা
রাতে আবু হুরায়রা (রা.) ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে তিনি দেখলেন—এক বিশাল খেজুরগাছ, যার ফল এত মিষ্টি যে তিনি কোনোদিন এমন স্বাদ পাননি। গাছটি তাঁর নামে দান করা হয়েছে এবং বলা হচ্ছে—“এই গাছটি হলো তোমার সেই এক খেজুর সদকার প্রতিদান।”
ঘুম ভেঙে গিয়ে তাঁর চোখে পানি চলে এলো। তিনি শোকর আদায় করলেন আল্লাহর প্রতি। তিনি বুঝতে পারলেন—আল্লাহ তা‘আলা সামান্য দানকেও কীভাবে অসীম পুরস্কারে রূপান্তর করেন।
আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা
পরদিন সকালে তিনি আবার রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে গেলেন। রাসূল (সা.) তাঁকে দেখে হেসে বললেন, “হে আবু হুরায়রা, আল্লাহ তোমার খেজুরকে পাহাড় বানিয়ে দিয়েছেন।”
আবু হুরায়রা (রা.) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কীভাবে জানলেন?”
রাসূল (সা.) বললেন, “জিবরাঈল (আ.) গত রাতে আমার কাছে এসেছিলেন এবং তোমার সদকার কথা বলেছেন।”
এমন সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? খোদ আকাশের ফেরেশতা নবীকে জানাচ্ছেন এক সাহাবীর খেজুর সদকার কথা!
শিক্ষা ও প্রভাব
এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই:
সদকা কখনো ছোট নয়: আল্লাহর কাছে সামান্য কিছুই অনেক বড় হয়ে যায় যদি তা হয় খাঁটি নিয়তে।
আল্লাহ গ্রহণ করেন হৃদয়ের নির্যাস: দানদাতা কত দিয়েছে তা নয়, কেন দিয়েছে—তা বড় প্রশ্ন।
আখিরাতের জন্য বিনিয়োগ: দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ক্ষুধার পরিবর্তে চিরস্থায়ী বাগান লাভই মুমিনের কামনা।
আত্মনির্ভরশীলতা ও তাওয়াক্কুল: আবু হুরায়রা (রা.) ছিলেন দরিদ্র, কিন্তু তিনি নিজের সামান্য খাদ্য থেকেও আল্লাহর জন্য দান করেছিলেন।
আবু হুরায়রার জীবনের অন্যান্য দিক
এই ঘটনা আবু হুরায়রার জীবনের একটি ক্ষুদ্র অধ্যায় মাত্র। তিনি ছিলেন হাদিসের সবচেয়ে বড় রাবি। প্রায় ৫,৩৭৪টি হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন। তাঁর জীবনে দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু তাতে তাঁর ঈমানের দৃঢ়তা একটুও কমেনি।
তাঁর মনে ছিল সদাই আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা। তিনি সবসময় ভাবতেন—“আজকে আমি কীভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারি?” এই চিন্তাই তাঁকে এমন এক চরিত্রে পরিণত করেছিল, যার কথা আজো কোটি কোটি মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
সমাপ্তি
আবু হুরায়রার একটি খেজুর সদকার এই ঘটনা আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়—আমরা যা কিছুই দিই, তা যেন হয় খাঁটি নিয়তে, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। সেটি হোক অর্থ, সময়, শ্রম কিংবা জ্ঞান—যদি তা হয় আল্লাহর পথে, তবে তার ফল হবে সীমাহীন।
আসুন, আমরা তাঁর এই শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি। সামান্য হলেও আমরা প্রতিদিন কিছু সদকা করার অভ্যাস গড়ে তুলি। হয়তো আমাদের একটি পানির বোতল দেওয়া, একটি খাবার দেওয়া, কিংবা একটি সহানুভূতির বাক্য বলাও কারো জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে, এবং আমাদের আখিরাতের জন্য উপার্জন হয়ে যেতে পারে এক বিশাল পাহাড়সম সওয়াব।
শেষ কথাঃ
আবু হুরায়রার (রা.) সদকা শুধু একটি খেজুরের দান নয়, বরং এটি ছিল তাঁর ঈমান, তাঁর আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, এবং তাঁর আখিরাতের প্রতি গভীর বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের জীবনেও এই বিশ্বাস গড়ে তোলাই হবে প্রকৃত সাফল্য।
#face
#national
#bangladesh
#international
#aface1
