একজন পাপীর কুকুরের প্রতি দয়া।
ইসলামের আলো এতটাই বিশাল ও উদার যে তা কখনো কারও অতীত দেখে নয়, বরং অন্তরের খাঁটি নিয়ত ও আমল দেখে বিচার করে। দুনিয়ার চোখে যিনি একজন পাপী—যাঁর জীবনে পুণ্যের আলো কম—তিনিও আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে দিতে পারেন একটি খাঁটি ও নিঃস্বার্থ কাজের মাধ্যমে। আজ আমরা এমন এক নারীর কাহিনি জানব, যিনি সমাজের চোখে ছিলেন পাপিষ্ঠ, কিন্তু একটি পশুর প্রতি দয়ার বদৌলতে জান্নাত লাভ করেন।
কাহিনির সূচনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের একটি অনন্য ঘটনা শুনিয়েছেন, যা ইতিহাসের পাতায় ‘একজন পাপী নারীর কুকুরের প্রতি দয়া’ নামে পরিচিত। এই কাহিনি শুধু পশুর প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষা দেয় না, বরং আল্লাহর অপার দয়ার, করুণার এবং অনুগ্রহের এক জীবন্ত প্রমাণও হয়ে দাঁড়ায়।
হাদিসটি এভাবে এসেছে:
“একবার এক পাপিষ্ঠা নারী চলছিল একটি মরুভূমির পথে। তখন সে দেখল, একটি কুকুর পিপাসায় মাটি চাটছে। নারীর অন্তর কেঁপে উঠল, তার দয়ামায়া জাগ্রত হল। সে নিজের চটি খুলে একটি কূপ থেকে পানি তুলে এনে কুকুরটিকে পান করাল। আল্লাহ তা‘আলা তার এই কাজের প্রতিদানে তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং জান্নাত দান করলেন।”
(সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)
মরুভূমির কঠিন বাস্তবতা
মরুভূমি কোনো সাধারণ জায়গা নয়। প্রচণ্ড গরম, পানির অভাব, নির্জনতা আর ঝুঁকি—সব মিলিয়ে এটি এক কঠিন পরীক্ষা। মানুষ তো বটেই, পশুর জীবনও হয়ে পড়ে হুমকির মুখে। একদিন ঠিক এমনই এক প্রচণ্ড রৌদ্রের দিনে, একজন নারী মরুভূমি পার হচ্ছিলেন।
এই নারী ছিলেন পাপী। হাদিসে তাঁকে "বাগী" বা ব্যভিচারিণী বলা হয়েছে—অর্থাৎ সমাজে তিনি নিন্দিত, তাঁর জীবনে আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্যুতি ছিল স্পষ্ট।
কিন্তু তাঁর হৃদয়ের একটি দরজা তখনো বন্ধ হয়নি—মায়া, দয়া ও মানবতা।
কুকুরটির অবস্থা
রাস্তার পাশে একটি কুকুর বসে ছিল। তার জিভ বের হয়ে আছে, চোখ কুঁচকে এসেছে, পিপাসায় সে যেন মারা যাচ্ছে। সে মাটি চাটছে, কারণ কোনো পানির উৎস খুঁজে পাচ্ছে না। এই দৃশ্য দেখে যে কেউ অবহেলা করে চলে যেতে পারত। কুকুর তো নাপাক প্রাণী, এমন একটা পশুর দিকে কি একজন পাপী নারী সহানুভূতি দেখাবে?
কিন্তু এই নারী থেমে গেলেন।
তিনি লক্ষ্য করলেন—এই পশু তার মতোই অসহায়। একদিন সমাজ তাকে যেমন ত্যাগ করেছে, আজ এই কুকুরটিও তেমনই নিঃস্ব, ত্যাগীত। এই পরিচয়বোধ থেকেই হয়তো তার অন্তরে করুণা জাগ্রত হলো।
সংকল্প ও কাজ
তিনি চারপাশে খুঁজলেন পানি। দূরে একটি কূপ পাওয়া গেল। কিন্তু সেখানে পানির জন্য কোনো দড়ি বা পাত্র নেই। এদিকে তাঁর নিজের সাথেও কিছু ছিল না।
তখন তিনি যা করলেন তা এক ব্যতিক্রমী ত্যাগ। তিনি তাঁর চামড়ার জুতো খুললেন, তারপর নিজের কাপড় বা ওড়না দিয়ে তা বেঁধে কূপে নামালেন, যতখানি পানির নাগাল পাওয়া যায়। অনেক কষ্টে পানি তুলে আনলেন।
এই কাজের সময় তিনি নিজেও তৃষ্ণার্ত ছিলেন। তিনি চাইলে নিজে আগে পানি পান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি আগে কুকুরটিকে পানি দিলেন।
কুকুরটি সেই পানি পান করে জীবন ফিরে পেল। তার চোখে যেন কৃতজ্ঞতার ছাপ। পশুরা কথা বলতে পারে না, কিন্তু তার আচরণ সবকিছু বলে দেয়।
আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার
এই কাজটি সমাজের চোখে হয়তো কিছুই না। মানুষ বলবে, “একজন পাপী নারী একটা কুকুরকে পানি দিল—তাতে কী এমন?”
কিন্তু আল্লাহর বিচার ভিন্ন।
এই নারী হয়তো জীবনভর পাপ করেছে, কিন্তু এই একটি কাজ ছিল নিখাদ, নিঃস্বার্থ ও খাঁটি হৃদয়ের। এতে ছিল মায়া, দয়া, ত্যাগ এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সম্মান।
রাসূল (সা.) বললেন:
“এই নারীর সে একটি দয়ার কারণে, আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।”
এখানে বোঝা যায়—আল্লাহ শুধু কাজ দেখেন না, কাজের পেছনের নিয়ত, অন্তরের গভীরতা এবং ত্যাগের পরিমাণ দেখেন।
শিক্ষা ও বার্তা
এই ছোট কাহিনি আমাদের জীবনের জন্য বহু শিক্ষা রেখে যায়। নিচে আমরা কয়েকটি শিক্ষা আলোচনা করবো:
১. আল্লাহর দরজা কখনো বন্ধ নয়
এমনকি একজন বড় পাপীও যদি খাঁটি মনে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো ভালো কাজ করেন, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতে পারেন।
২. পশুর প্রতিও দয়া করা সওয়াবের কাজ
ইসলামে শুধু মানুষের প্রতি নয়, পশু-পাখির প্রতিও সদয় হওয়া এক মহান গুণ। রাসূল (সা.) বলেছেন:
“প্রত্যেক জীবন্ত প্রাণীর প্রতি দয়া করা সওয়াবের কাজ।”
(সহিহ মুসলিম)
৩. নিয়তের বিশুদ্ধতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
নারীটির দয়া ছিল সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ। না ছিল সমাজের স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা, না ছিল লোক দেখানো কাজ। তাই এই কাজের পুরস্কার এত মহান হলো।
৪. পাপীরাও আশাবাদী হতে পারে
এই হাদিস সেইসব মানুষদের জন্য বিশেষ বার্তা বহন করে, যারা মনে করে “আমার গুনাহ এত বেশি, আমি তো জান্নাত পাব না।”
না! আল্লাহর রহমত গুনাহ থেকে অনেক বড়।
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
আমাদের জীবনেও এমন বহু সুযোগ আসে, যখন আমরা চাইলে দয়ালু হতে পারি। হয়তো একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালকে খাবার দেওয়া, একটি কুকুরকে রাস্তায় পানি খাওয়ানো, গাছের নিচে পানি রাখা—এসবই একেকটি সদকার কাজ।
সাধারণ কাজেই আল্লাহ অসাধারণ পুরস্কার দিতে পারেন, যদি তা হয় বিশুদ্ধ নিয়তে।
একটি প্রশ্ন: সমাজের চোখে পাপী, আল্লাহর কাছে প্রিয়?
আমরা অনেক সময় মানুষকে তার অতীত দিয়ে বিচার করি। কাউকে যদি দেখি সে মসজিদে যায় না, বা ইসলামী পোশাক পরে না—তাকে অবহেলা করি।
কিন্তু আল্লাহ যাকে চান, যেভাবে চান—ক্ষমা করে দিতে পারেন। আল্লাহ বলেন:
“বল, হে আমার সেই বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর সীমালঙ্ঘন করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন।”
(সূরা যুমার ৩৯:৫৩)
এই আয়াত সেই পাপী নারীটির জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।
#face
#national
#bangladesh
#international
#aface1