🌧️ বৃষ্টির সেই বিকেল
সকাল থেকেই যেন একটা ভারী অপেক্ষা ঝুলে ছিল আকাশে। মেঘগুলো জমেছিল ধীরে ধীরে, ছায়া ফেলেছিল শহরের উপর। শহরের মানুষরা জানত, আজ কিছু একটা হতে চলেছে। কেউ হয়তো অফিসের পথে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে, কেউ আবার ভিজে যাওয়ার অজুহাতে বাড়িতে থাকার পরিকল্পনা করছে।
আর মৃত্তিকা?
সে বসে ছিল বারান্দায়, পায়ে ছড়ানো একটা পুরোনো চাদর। কাঁধে একটা মলিন শাল, হাতে ধরা একটা মগ—চা নয়, কেবল গরম পানি। জানালার ওপাশে তখনো বৃষ্টি নামেনি, কিন্তু মাটির গন্ধ যেন আগে থেকেই চলে এসেছে।
আজকের দিনটা তার জন্য খুবই স্পেশাল—তবে উৎসবের জন্য নয়।
আজ ৩রা জুন—যে দিনটাতে রাহুল প্রথমবার মৃত্তিকার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
প্রথম দেখা
তিন বছর আগে, একই দিনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমেছিল। ছাতাহীন মৃত্তিকা ছুটছিল বিশৃঙ্খলভাবে, তখনই তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল একটা ছাতা। আর ছাতার নিচে ছিল একজোড়া উজ্জ্বল চোখ, আর একটুকরো হাসি—রাহুল।
“একা ভিজবেন না, আমাকে একটু জায়গা দিন,” রাহুল বলেছিল এমন ভাবে, যেন বহুদিন ধরেই মৃত্তিকার সঙ্গে তার পরিচয়।
তাদের সেই ছাতা ভাগাভাগি করা থেকেই শুরু। লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, ক্লাসের করিডোর—সব জায়গাতেই জমে উঠেছিল গল্প। বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে হাঁটা যেন তাদের আলাদা একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়।
সম্পর্কের গভীরতা
রাহুল ছিল শিল্প-প্রেমিক, কবিতা লিখত। আর মৃত্তিকা—সে ছিল গানের মানুষ। সন্ধ্যায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসে গান আর কবিতায় হারিয়ে যেত।
একবার বৃষ্টি হচ্ছিল খুব, পুকুরপাড়ে তারা বসেছিল ভিজে গায়ে। রাহুল কাঁপছিল, কিন্তু বলল,
“তুই জানিস, বৃষ্টি হলেই আমার তোকে বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।”
মৃত্তিকা সেদিন কিছু বলেনি। শুধু চোখ বুজে শুনেছিল রাহুলের সেই কথাগুলো—সেগুলো আজও তার মনে বাজে।
হঠাৎ ছন্দপতন
জীবন ঠিক যেমন করে আনন্দ দেয়, ঠিক তেমন করেই হুট করেই তা ছিনিয়েও নেয়।
রাহুল একদিন তার বাইকে করে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
একটা লাল ট্রাকের সামনে সব গল্প থেমে যায়।
মৃত্তিকার জীবনে তখন নীরবতার বৃষ্টি নামে—যে বৃষ্টি কোনো দিন থামে না।
আজকের দিন
আজ সেই দিনটাই ফিরে এসেছে।
বারান্দার গায়ে প্রথম ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ পড়ে। মৃত্তিকা কাঁপে না, শুধু শূন্য চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তার পাশে একটা পুরোনো ছাতা রাখা, যার হাতলে আজও রাহুলের ছোঁয়ার ছাপ রয়ে গেছে।
সে ছাতাটা হাতে নেয়। অনেক দিন পর সে বের হয় বাইরে, সেই পুরোনো গলিটা ধরে হাঁটে। চারপাশে বৃষ্টি নেমেছে, মানুষ ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু মৃত্তিকা থামে না।
সে চলে যায় সেই পুরোনো পুকুরপাড়ে। বসে পড়ে। পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে টুপটাপ শব্দ তোলে।
হঠাৎ তার পাশে বসে কেউ যেন ফিসফিস করে বলে, “তুই জানিস, বৃষ্টি হলেই আমার তোকে বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।”
সে জানে, কেউ নেই। তবুও সে চোখ বন্ধ করে হাসে।
বৃষ্টি তার চুলে পড়ে, গায়ে পড়ে, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কান্নার মতো।
কিন্তু আজকের বৃষ্টিতে কেমন যেন একটা উষ্ণতা আছে।
একটা আশ্বাস—যে ভালোবাসা হারায় না, থেকে যায়, ঠিক এই রকম কোনো এক বৃষ্টির বিকেলে।