ছায়াপথের দিকে
শহরের গলির শেষ মাথায় একটা পুরনো দোতলা বাড়ি, জানালায় ধুলোমাখা পর্দা ঝুলছে, দেয়ালে ফাটল। বাড়িটার নাম "ছায়াপথ"—এই নামটা লিখা একটা কাঠের ফলকে, যেটা অনেক আগেই রংচটা হয়ে গেছে। এই বাড়িতেই থাকতো একজন মানুষ—রায়হান। পঁয়ত্রিশ বছরের এই মানুষটা যেন শহরের ব্যস্ততায় এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ।
রায়হান একা থাকে। চাকরি করে একটি পুরাতন লাইব্রেরিতে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বই ঘাঁটা, ধুলো ঝাড়া, পাঠকদের বই খুঁজে দেওয়া—এই ছিল তার রোজকার কাজ। তবে অফিস শেষে তার যাত্রা হতো অন্য এক জগতে।
রায়হান রাত হলেই ছাদে উঠে যেত। তার পছন্দের কাজ—আকাশ দেখা, নক্ষত্র গোনা। সে বিশ্বাস করত, প্রতিটা নক্ষত্রের পেছনে একটা গল্প আছে। মাঝে মাঝে সে একটা পুরনো নোটবুকে কিছু লেখা লিখত—ছড়া, গল্প, নিজের ভাবনা। কিন্তু সেই লেখা কখনো কাউকে দেখায়নি।
তার বন্ধুবান্ধব নেই বললেই চলে। প্রতিবেশীরাও জানে, "রায়হান সেই পাগলা বইওয়ালা, যার রাত কাটে আকাশ দেখে।"
একদিন লাইব্রেরিতে এল নতুন এক মেয়ে—মায়া। চোখে চশমা, হাতে ক্যামেরা, বয়স কমবেশি পঁচিশ। মায়া একজন ফটোজার্নালিস্ট, শহরের ঐতিহাসিক জায়গা আর মানুষের গল্প নিয়ে কাজ করে। লাইব্রেরিতে পুরনো বই নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছিল।
রায়হান প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু মায়া অন্যরকম ছিল—সব কিছুর প্রতি কৌতূহলী, সব কথা মন দিয়ে শুনে। ওর প্রশ্ন, “আপনি কেন এত পুরনো বই পড়েন? সময় তো অনেক বদলে গেছে।”
রায়হান মৃদু হেসে বলেছিল, “কারণ সময় বদলালেও কিছু গল্প রয়ে যায় চিরকাল। যেমন তুমি।”
মায়া হেসে ফেলেছিল, “আমি? আমি তো নতুন!”
“তবে তুমিই সেই নতুন গল্প, যেটা এখনো লেখা হয়নি,” রায়হান জবাব দিয়েছিল।
এই প্রথম কেউ রায়হানের ভাষা বুঝতে পেরেছিল। এরপর থেকে মায়া প্রায়ই আসত লাইব্রেরিতে। ওরা আকাশ, বই, ইতিহাস, ভবিষ্যৎ—সব কিছু নিয়ে কথা বলত। রায়হান প্রথমবার অনুভব করল, একা থাকা আর একাকীত্ব এক জিনিস নয়।
একদিন মায়া তাকে বলল, “আমি একটা প্রজেক্ট করছি—'নীরব শহর' নামে। যারা একা থাকে, যারা সমাজের ছায়ার মধ্যে থাকে, তাদের নিয়ে। আমি চাই আপনার গল্পটাও থাকুক।”
রায়হান চমকে উঠল। “আমার গল্প? কিন্তু আমি তো খুব সাধারণ...”
মায়া বলল, “এটাই তো বিশেষ। তোমার আকাশ দেখা, নক্ষত্রের গল্প লেখা—এই সবই তো ছায়ার ভেতরের আলো। মানুষ জানুক এসব কথা।”
রায়হান প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু মায়ার একরোখা চাহনি আর বিশ্বাসের কাছে হার মানল। সে তার লেখা, ছাদে বসে দেখা আকাশের ছবি, এমনকি তার একটা গোপন কবিতার খাতা পর্যন্ত মায়াকে দিল।
মায়া বলল, “তুমি জানো, তুমি যা লিখো তা কেবল সাহিত্য না, তা এক রকম বিজ্ঞানও। তুমি জানো, তোমার লেখা অনেকের চোখ খুলে দিতে পারে?”
প্রথমবারের মতো রায়হান বুঝল—তার নিঃশব্দ দিনগুলো আসলে গল্প হয়ে উঠেছে।
মাসখানেক পরে, শহরের এক বড় আর্ট গ্যালারিতে “নীরব শহর” প্রজেক্টের প্রদর্শনী হল। বড় বড় ফ্রেমে ঝুলছিল মায়ার তোলা ছবি, প্রতিটা ছবির পাশে গল্পের টুকরো। রায়হানের ছাদ, তার নীল ডায়েরির কবিতা, তার নক্ষত্র চিহ্নিত মানচিত্র—সবই জায়গা পেয়েছিল সেখানে।
অসংখ্য মানুষ এসে দেখল সেই গল্প। রায়হান কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ এক বাচ্চা ছেলে এসে বলল, “আপনি কি ছাদে বসে নক্ষত্র দেখেন সেই মানুষ? আমি আপনার মতো হতে চাই!”
রায়হান চমকে গেল। এই শহরে সে প্রথমবার অনুভব করল—তার নিঃশব্দতাও কথা বলে।
মায়া পাশে এসে দাঁড়াল, “তুমি ছায়াপথের মানুষ, কিন্তু তোমার আলো অন্যদের পথ দেখায়, জানো?”
রায়হান হেসে বলল, “এখন জানি।”
তারপর থেকে রায়হান আর আগের মতো থাকেনি। সে তার লেখা ছড়িয়ে দিতে শুরু করল, ছোট ছোট লাইব্রেরি ক্লাবে পাঠ করত, শিশুদের সঙ্গে তার আকাশ দেখা ভাগ করে নিত।
“ছায়াপথ” বাড়িটা এখন আর কেবল একটা ধুলোমাখা জায়গা নয়। সেখানে আলো জ্বলে রাতে, চায়ের কাপ বেজে ওঠে আড্ডায়, আর জানালায় এখন নতুন পর্দা লাগানো—নীল রঙের, তারার ছাঁপা।
---
শেষ কথা:
এই শহরের প্রতিটা কোণায় হয়তো রায়হানের মতো কেউ থাকে—চুপচাপ, একা, নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা। কিন্তু একটুখানি ভালোবাসা, একটুখানি মনোযোগ, আর একটা প্রশ্ন—“তুমি কেমন আছো?”—এইটুকুই বদলে দিতে পারে একজন মানুষের গল্প।
কারণ ছায়ার মধ্যেই তো সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা দেখা যায়।
Saymon Ahmed
Ta bort kommentar
Är du säker på att du vill ta bort den här kommentaren?