সততা ও বুদ্ধিমত্তার গল্প: হযরত উমরের (রা.) ন্যায়বিচার
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে যেসব ব্যক্তিত্ব আল্লাহর ন্যায়বিচার ও খিলাফতের আদর্শ রূপ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) অন্যতম। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা, এবং ইসলামী শাসনের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন যা আজও বিশ্বের জন্য আদর্শ।
এই গল্পটি তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা, যেখানে সততা, বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায়বিচারের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়।
প্রথম দৃশ্য: এক গরিব আর এক বিত্তবান
মদিনায় একদিন দুই ব্যক্তি একসঙ্গে খলিফার দরবারে উপস্থিত হলো। একজন ছিল ধনী, ব্যবসায়ী; অন্যজন গরিব রাখাল। তাদের মধ্যে এক জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। ব্যবসায়ী দাবি করল:
"এই জমিটি আমার। আমি আমার টাকায় এটি কিনেছি। এখানে আমি গাছ লাগিয়েছি, খাল কেটেছি, পানি এনেছি। এই রাখাল অবৈধভাবে আমার জমিতে পশু চরিয়েছে।"
রাখাল বলল:
"হুজুর, এই জমি আমি আমার দাদার কাছ থেকে পেয়েছি। আমরা এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করছি। জমির দলিল আমাদের কাছে না থাকলেও প্রমাণ আছে। ব্যবসায়ী সাহেব শুধু পাশের জমি কিনেছেন। এখন আমাদের জমিটিও নিজের বলে দাবি করছেন।"
হযরত উমর (রা.) দু’জনের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কোনো পক্ষের প্রতি পক্ষপাত না করে বললেন:
"প্রমাণ আনো। কাগজ, সাক্ষ্য, যেটা আছে—তুলে ধরো।"
দ্বিতীয় দৃশ্য: ন্যায়বিচারের যাত্রা শুরু
ব্যবসায়ী বহু দলিল নিয়ে এলো। জমির মালিকানা, মেপে নেয়ার কাগজ, স্থানীয় একাধিক সাক্ষী—সবই তার পক্ষে। গরিব রাখাল শুধু কিছু পুরনো প্রতিবেশীকে সাক্ষী হিসেবে নিয়ে এলো, যারা বলল:
"আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, এই রাখালের পরিবার এই জমিতে পশু চড়ায়। তবে লিখিত কিছু আমাদের জানা নেই।"
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল ধনীর পক্ষেই রায় যাবে। কিন্তু উমর (রা.) তখন বললেন:
"আমরা শুধু দলিল নয়, যুক্তিও দেখবো। এমন কোনো প্রমাণ নেই কি, যা জমির প্রকৃতি থেকে বোঝা যায় কার মালিকানা?"
তৃতীয় দৃশ্য: তদন্তের গভীরে
উমর (রা.) নিজেই গেলেন সেই জমিতে। তিনি মাঠে গিয়ে রাখালকে বললেন:
"তুমি কোথায় পশু বেঁধে রাখো?"
রাখাল এক গাছের নিচে নিয়ে গেল। উমর (রা.) লক্ষ করলেন, গাছের গুঁড়িতে বহু বছরের পুরনো দড়ির দাগ, যেটা বোঝায় দীর্ঘকাল এখানে পশু বাঁধা হয়েছে।
তারপর তিনি গাছের আশেপাশে মাটিতে হাত দিলেন। শুকনো মাটি কিছুটা খুঁড়ে দেখলেন নিচে পুরনো ছাই ও গোবরের স্তর—যা দীর্ঘদিন ধরে পশুপালনের প্রমাণ। এটা প্রমাণ করল, এই জমি শুধু সাম্প্রতিক দখল নয়, দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহৃত হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীর জমিতে দেখা গেল সাজানো বাগান, তবে তা সদ্য গড়া। গাছের শিকড়গুলো পর্যন্ত ছিল কাঁচা। এসবই প্রমাণ করল যে তার দখল নতুন।
চতুর্থ দৃশ্য: বুদ্ধির ব্যঞ্জনা
উমর (রা.) এরপর দুই পক্ষকে ডেকে বললেন:
"দেখো, দলিল থাকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবতা ও ব্যবহারও সাক্ষ্য দেয়। প্রকৃত মালিকানার ভিত্তি শুধু কাগজ নয়—কাজ, উপস্থিতি ও সময়ের সাক্ষ্যও তার অন্তর্ভুক্ত।"
তিনি আরও বললেন:
"তোমার জমি তুমি কিনেছ, ব্যবসায়ী সাহেব। কিন্তু যার দখলে জমি বহু বছর ধরে আছে, সে যদি তোমার জমির সীমানার বাইরে থাকে, তাহলে সেটা তার নিজস্ব। তুমি অতিরিক্ত জমির দাবি করতে পারো না।"
এই বলে উমর (রা.) রায় দিলেন:
গরিব রাখাল তার পূর্বপুরুষদের জমিতে বৈধভাবে আছে।
ব্যবসায়ীর জমি তার সীমার মধ্যেই থাকবে, এবং সে যেন সীমানা ছাড়িয়ে না যায়।
জমির সীমানায় একটি ছোট দেয়াল নির্মাণ করা হবে যেন ভবিষ্যতে বিরোধ না হয়।
পঞ্চম দৃশ্য: সততার পুরস্কার
রায় শোনার পর, ব্যবসায়ী রেগে না গিয়ে মাথা নত করল। সে বলল:
"আমি বুঝতে পারছি হুজুর, আপনি আমার দৃষ্টির সীমার বাইরের বিষয় দেখেছেন। আমি কাগজের ওপর ভরসা করেছিলাম, কিন্তু আপনি মানুষ ও পরিবেশের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। আপনি সত্যিকারের বিচারক।"
গরিব রাখাল কাঁদতে কাঁদতে বলল:
"আমি তো ভেবেছিলাম, কেউ ধনী হলে সব পায়। কিন্তু আপনি প্রমাণ করলেন, আল্লাহর কাছে সৎ থাকলেই যথেষ্ট।"
সমাপ্তি: উমরের (রা.) উত্তরাধিকার
এই ঘটনা মদিনার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বলতে লাগল—"উমরের শাসন মানে ন্যায়বিচার, ধনী ও গরিবের সামনে সমান আইন।"
হযরত উমর (রা.) সেই দিন তাঁর মজলিসে বলেছিলেন:
"সততা যদি অন্ধকারেও থাকে, তা আলোর মতো জ্বলে উঠে। আর বুদ্ধিমত্তা তখনই সফল হয়, যখন তা অন্যায় থেকে মানুষকে রক্ষা করে।"
📚 শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ:
সততা ও সত্য সবসময় শক্তিশালী। প্রমাণ থাক বা না থাক, সত্য প্রকাশ পায়।
ন্যায়বিচার কেবল আইন দেখে নয়, বরং বাস্তবতা ও বিবেক দিয়ে নির্ধারণ করতে হয়।
বুদ্ধিমত্তা মানে কেবল কথা বলা নয়, বরং সময় ও পরিস্থিতি বুঝে কাজ করা।
ক্ষমতার ব্যবহার যদি সঠিকভাবে হয়, তা সমাজে নিরাপত্তা ও ন্যায়ের আলো ছড়ায়।