মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসার গল্প।
প্রথম অধ্যায়: ব্যস্ততার শহরে
ঢাকার ব্যস্ত নগরজীবনে কাজল ছিল এক সফল যুবক। নাম করা একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, সব কিছুই ছিল তার জীবনে। বন্ধুদের কাছে সে ছিল “আদর্শ জীবনের” এক উদাহরণ।
কিন্তু একদিন হঠাৎ তার মা ফোন দিলেন গ্রাম থেকে।
“বাবা, তোর আব্বার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ইদানীং খুব হাঁপায়...”
কাজল বলল, “আচ্ছা মা, সময় পেলেই আসব। এখন অনেক ব্যস্ততা।”
ফোন রেখে আবার নিজের ফাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। মায়ের সেই কথাগুলো যেন কোথাও হারিয়ে গেল।
দ্বিতীয় অধ্যায়: স্মৃতির জানালা
সেই রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ গাড়ির ভেতর রেডিওতে ভেসে এলো:
“মা-বাবা তোমার জান্নাতের দরজা। যখন তারা ডাকে, তুমি সাড়া দাও। তাদের হাসি মানেই তোমার সৌভাগ্যের চাবি।”
গানের কথা কাজলের হৃদয়ে হঠাৎ ছোঁয়া দিয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেল—
ছোট্ট এক কাজল গ্রামের মাটির ঘরে বসে আছে। তার গায়ে জ্বর, আর মা ঠান্ডা পানি দিয়ে পিঠ মুছে দিচ্ছে, আর বলছে:
“আল্লাহ রে, আমার বাবার জ্বর কমুক... আমি কিছু চাই না।”
মুখে তেলের বাতি হাতে, বাবা এসে বলছেন:
“মা, একটু গরম দুধ দে তো, ওকে খাইয়ে দিই। আজ তো আমাদের ছেলের জ্বর কমে এসেছে।”
কাজল হঠাৎ নিজের চোখ মুছে নিল। সে বুঝল—সে অনেক দূরে চলে এসেছে, অনেক দূরে…
তৃতীয় অধ্যায়: ফেলে আসা ভালোবাসা
পরদিন সকালে কাজল হঠাৎ অফিসে গিয়ে বস বললেন:
“কাজল, আগামী সপ্তাহে তোমাকে মালয়েশিয়া যেতে হবে। একটা বড় ক্লায়েন্ট মিটিং।”
কাজল একটু চুপ করল। তারপর আস্তে বলল:
“স্যার, আমি যেতে পারব না। আমার বাবার শরীর খারাপ। তাকে দেখতে গ্রামে যেতে চাই।”
বস একটু চমকে গেলেন। কাজল বলল না, কিন্তু তার চোখ বলে দিল—এটাই আসল কাজ, আসল দায়িত্ব।
চতুর্থ অধ্যায়: গ্রামের পথে ফেরা
দুই দিন পর কাজল রওনা দিল তার পুরনো গ্রামে—নড়াইলের পাশে এক ছোট্ট জনপদ। সবুজ ধানের মাঠ, মাটির রাস্তা, আর সেই পুরনো পুকুর।
সে যখন বাড়িতে পৌঁছাল, তখন বিকেল। বারান্দায় বসে ছিলেন তার মা। তাকে দেখে মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন:
“তুই তো বলেছিলি, অনেক কাজ। হঠাৎ এলি যে বাবা!”
কাজল হাসল, কিন্তু চোখের কোণ ভিজে উঠল। ঘরে ঢুকে দেখল—বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন, চোখ দুটো কিছুটা নরম, ক্লান্ত।
“বাবা, আমি কাজল। আমি এসেছি...”
বাবা চোখ মেলে চাইলেন, আর ফিসফিস করে বললেন:
“তুই? আমার কাজল? আলহামদুলিল্লাহ।”
পঞ্চম অধ্যায়: দায়িত্বের আসল অর্থ
গ্রামের সেই দিনে কাজল আবিষ্কার করল নতুন কিছু—মায়ের রান্না, বাবার ওষুধ ঠিকমতো দেওয়া, রাতে মশা তাড়িয়ে ঘুম পাড়ানো, সকালে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া—এসবই যেন নতুন এক জীবন।
তিন দিন পর কাজলের বাবা বললেন:
“বাবা, তোর জীবনে অনেক কিছু হয়েছে। আমরা খুব খুশি। কিন্তু জানিস, সব থেকে বড় অর্জন কী?”
কাজল বলল, “কী বাবা?”
“জান্নাতের দরজা খোলা থাকে মা-বাবার সন্তুষ্টিতে। যদি তুই আমাদের খুশি রাখতে পারিস, তাহলে দুনিয়া তো জিতলিই, আখিরাতও জিতবি।”
সেদিন কাজলের মনে হলো—সে এত বছর যেন অন্ধকারে ছিল।
ষষ্ঠ অধ্যায়: পুরনো চিঠির কাহিনি
কাজল একদিন পুরনো কৌটো খুলে দেখতে পেল একটি চিঠি—তার মায়ের লেখা, যখন সে বিদেশে পড়ত।
“বাবা, আমি জানি তুই ব্যস্ত। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় তুই যদি একটু পাশে থাকতিস! তোর কষ্টের কথা ভাবি, দোয়া করি, কিন্তু আমরাও তো মানুষ। আমরা শুধু একটা কথাই চাই—তুই যেন কখনো আমাদের ভুলে না যাস।”
চিঠির অক্ষরগুলো যেন চোখে ধোঁয়া লাগিয়ে দিল। কাজল বুঝল, সে শুধু টাকার দায়িত্ব বুঝত, কিন্তু ভালোবাসার দায়িত্ব বোঝেনি।
সপ্তম অধ্যায়: দান নয়, সহবাস
গ্রামে থাকতে থাকতে কাজল একদিন দেখল—পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা কাঁদছেন। ছেলে শহরে টাকা পাঠায়, কিন্তু মা বলেন:
“ও শুধু টাকা পাঠায়, কিন্তু ওর স্পর্শ পাই না। ওর মুখ দেখি না। আমি কি শুধু খাবার আর ওষুধের জন্য বাঁচি?”
সেদিন কাজল বুঝল, মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব শুধু অর্থমূলক নয়—তা মানসিক, শারীরিক ও আত্মিক।
অষ্টম অধ্যায়: ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত
কাজল শহরে ফিরে আসার আগের রাতে তার মা বললেন:
“বাবা, তুই এত ব্যস্ত। আল্লাহ তোকে হিফাজত করুক। কিন্তু মাঝে মাঝে ফোন দে, ছবি দে, একটু আমাদের কথা ভাব।”
বাবা বললেন:
“দেখিস, যতো বড় হই না কেন, মা-বাবার সামনে আমরা সব সময়ই ছোট। যেন আবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটছি।”
কাজল মুচকি হেসে বলল:
“এখন থেকে প্রতিদিন একটু একটু করেই হাঁটব তোমাদের সঙ্গে।”
শেষ অধ্যায়: আসল সফলতা
ফিরে এসে কাজল নিজের ঘরের দেয়ালে একটি নতুন পোস্টার টানাল। সেখানে লেখা:
“তুমি যখন ছোট ছিলে, তারা তোমার জন্য ঘুমাত না। এখন তুমি বড় হয়েছ—তাদের ঘুম যেন না ভাঙে তোমার অবহেলায়।”
সে এখন প্রতিদিন বাবা-মায়ের খোঁজ নেয়। প্রতি তিন মাসে একবার গ্রামে যায়। এবং নিজের অফিসে সবার জন্য একদিন নির্ধারণ করে দেয়—
"পিতা-মাতা দিবস: যার জন্য আমরা আছি, তাদের একটিবার দেখে আসি।"
📚 শিক্ষণীয় বিষয়:
মা-বাবা কেবল দান নয়, সাহচর্য চান।
আবেগ ও উপস্থিতি—দুইই সন্তানের বড় দায়িত্ব।
সফলতা তখনই পূর্ণ হয়, যখন তার সঙ্গে মা-বাবার দোয়া থাকে।
যারা মা-বাবার সেবা করে, তাদের জান্নাতের দরজা সহজ হয়।
সময়মতো ভালোবাসা না দিলে, পরবর্তীতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ নাও মিলতে পারে।