মেঘ ও দানশীল কৃষকের কাহিনী
ভূমিকা
আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের রিজিক দেন বিভিন্ন মাধ্যমে। কখনো তিনি পরীক্ষা করেন সম্পদ দিয়ে, কখনো অভাব দিয়ে। আর তিনি ভালোবাসেন সেই বান্দাদের, যারা তার দেওয়া নেয়ামতকে শুধু নিজের জন্য না রেখে অন্যের কল্যাণে ব্যয় করে।
এই গল্পটি এমনই এক কৃষকের, যার দানশীলতার কারণে আল্লাহ তার জন্য এক মেঘকে নিয়োজিত করে দিলেন...
ভিন্ন এক মেঘের আচরণ
মরুভূমির পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি হাঁটছিলেন। হঠাৎ আকাশে একটা মেঘের টুকরো ভেসে আসল। প্রচণ্ড রোদে যখন চারিদিক পুড়ে যাচ্ছে, তখন সেই মেঘ ছিল এক ব্যতিক্রম। সেটি চলছিল খুব ধীরগতিতে, যেন কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে।
হঠাৎ সেই ব্যক্তি শুনতে পেলেন, মেঘ থেকে একটি আওয়াজ ভেসে এলো—
“অমুক ব্যক্তির বাগানে পানি দাও।”
তিনি চমকে গেলেন! কে এই ব্যক্তি? কী এমন করেছেন যে আকাশের মেঘ তাকে পানি দিচ্ছে?
মেঘের অনুসরণ
জিজ্ঞাসা ও কৌতূহলে ব্যক্তি সেই মেঘকে অনুসরণ করতে লাগলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মেঘটি এক পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে বৃষ্টি শুরু করল। পানি একটি খালের মধ্যে গড়িয়ে পড়ল, যা একটি নির্দিষ্ট বাগানের দিকে প্রবাহিত হলো।
তিনি দ্রুত সেই বাগানের কাছে পৌঁছালেন এবং দেখলেন এক কৃষক নিজ হাতে পানি প্রবাহিত করে তার খেজুর গাছে দিচ্ছেন।
তিনি বললেন, “হে আল্লাহর বান্দা! তোমার নাম কী?”
কৃষক বললেন, “আমার নাম অমুক।” ঠিক সেই নাম, যা তিনি মেঘের আওয়াজে শুনেছিলেন।
আশ্চর্য ব্যক্তি ও কৃষকের পরিচয়
ভ্রমণকারী বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি তোমার বাগানে মেঘ থেকে আওয়াজ শুনেছি, ‘অমুক ব্যক্তির বাগানে পানি দাও।’ আমি সেই মেঘ অনুসরণ করে এসেছি। আল্লাহ তোমার জন্য নিজ মেঘ দিয়ে পানি বর্ষণ করিয়েছেন! বলো, তুমি কী করো? এমন কী আমল করো যার ফলে এই বরকত?”
কৃষক লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন, “তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, তবে বলি। তবে এটি কেবল আল্লাহর জন্য করি, তাই বলতেও সংকোচ হয়।”
দানশীল কৃষকের গোপন রহস্য
কৃষক বললেন, “আমি যা ফসল উৎপন্ন করি, তার তিনভাগ করি:
এক ভাগ নিজের পরিবার ও প্রয়োজনের জন্য রাখি।
এক ভাগ আল্লাহর রাস্তায় দান করি—মিসকিন, ইয়াতিম, মাদ্রাসা, মসজিদে।
আর এক ভাগ জমিতে ফিরিয়ে দিই—বীজ, শ্রমিকের বেতন, কৃষি উন্নয়নে।
আমি আমার রিজিকের প্রতিটি কণায় আল্লাহর বরকত দেখতে চাই। আমি জানি, যা আল্লাহর জন্য দান করি, সেটিই স্থায়ী।”
মেঘের রহস্য উদঘাটন
ভ্রমণকারী বিস্মিত হয়ে বললেন, “তোমার দান আল্লাহর দরবারে এমনভাবে কবুল হয়েছে যে, তিনি তোমার জমির জন্য এক মেঘ নিয়োজিত করেছেন! এমন কতজন কৃষক আছে, যারা শস্য উৎপাদন করে কিন্তু পানি পায় না! অথচ তুমি, বিনিময়ে শুধু আল্লাহর জন্য দান করো, আর আসমান তোমার জন্য বৃষ্টি ঝরায়!”
গল্পের পটভূমি: সহীহ হাদীস
এই কাহিনি শুধুমাত্র একটি গল্প নয়। এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি সহীহ হাদীসের বর্ণনা, যা মুসলিম শরীফে এসেছে।
রাসূল ﷺ বলেন:
**"এক ব্যক্তি এক মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি একটি মেঘ শুনলেন, যাতে বলা হচ্ছিল, ‘অমুকের বাগানে পানি দাও।’ মেঘটি সরে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বৃষ্টি দিল, এবং সেই পানি এক খালে গিয়ে পড়ল। তিনি খালের ধারে এক কৃষককে দেখতে পেলেন, যিনি পানি তার বাগানে প্রবাহিত করছিলেন।
তখন তিনি কৃষককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করো?
কৃষক বলল, আমি যা ফসল পাই তা তিনভাগ করি—একভাগ দান করি, একভাগ খাই, একভাগ পুনর্ব্যবহার করি।"**
(সহীহ মুসলিম: 2984)
কৃষকের মনোভাব: দান মানে খালি হওয়া নয়, ভরে যাওয়া
কৃষকের মনোভাব ছিল এই: “আমি যত দান করি, তত আমার জমিতে বরকত বাড়ে। আমি যত দেই, তত পাই।” এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল একজন আল্লাহওয়ালার মনেই থাকতে পারে।
এখানে দান মানে শুধু টাকার খরচ নয়, বরং বিশ্বাসের বিনিয়োগ। তিনি বুঝেছিলেন, এই জগতে আসল মালিক তিনি নন, বরং আল্লাহ। তিনি শুধু ‘আমানতদার’—একটি ফসল-ভরা জমির, একটি ভরে ওঠা কলিজার।
আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে বলেন:
“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যা কিছু ব্যয় কর, আল্লাহ তার প্রতিদান দেবেন। আর তিনিই সেরা রিযিকদাতা।”
(সূরা সাবা: ৩৯)
আরেক আয়াতে তিনি বলেন:
"যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তাদের উপমা হলো একটি শস্যবীজ, যা থেকে সাতটি শীষ গজায়, আর প্রতিটি শীষে একশত দানা।"
(সূরা বাকারা: ২৬১)
উপসংহার: মেঘ তোমার দিকে বর্ষণ করবে?
এই গল্প আমাদেরকে চিন্তা করতে বাধ্য করে—আমি কি আমার জীবনের "ফসল" থেকে আল্লাহর জন্য কিছু আলাদা করেছি? আমি কি আল্লাহর দেওয়া রিজিকের হক আদায় করছি? আমি কি এমন দানশীল যে আমার কারণে আকাশের মেঘ আমাকে খুঁজে আসে?
জীবনের দিকে ফিরে দেখা
যদি তুমি ব্যবসায়ী হও: মুনাফার একটি অংশ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো।
যদি তুমি ছাত্র হও: সময় ও জ্ঞান দিয়ে সেবার কাজ করো।
যদি তুমি কৃষক হও: ফসলের একটি অংশ গরীবের জন্য রাখো।
যদি তুমি গৃহিণী হও: রান্না করা খাবারের একটি ভাগ মিসকিনের জন্য রাখো।
দান শুধুই টাকা নয়। দান মানে হৃদয় উজাড় করে দেওয়া। আর আল্লাহ সেই হৃদয়টাই দেখতে চান।
শেষ কথা
একটি বীজ জমিতে পড়লে সাতশ গুণ হয়ে ওঠে। কিন্তু একটি দান যদি পড়ে কোনো মিসকিনের অন্তরে, তবে তা হয়তো হয়ে উঠবে আখিরাতে পাহাড়সম প্রতিদান।
হে পাঠক, আসুন আমরাও এমন দানশীল হই, যেন একদিন আকাশের কোনো মেঘ আমাদের জমির ওপর নেমে আসে—শুধু আমাদের নিয়ত, আমাদের দানশীলতার কারণে।