ভাঙা চিঠির শব্দে
কলেজ জীবনের সেই দিনগুলোতে কাফির ভেতরে যেন এক ধরনের নীরব আগুন জ্বলতো। সে খুব একটা কথা বলতো না, কারো সঙ্গে বেশি মিশতও না। কিন্তু যেদিন প্রথম ক্লাসে সানজিদাকে দেখে, সে দিন থেকেই তার হৃদয়ের ভিতরে কিছু একটার জন্ম হয়। যেন সানজিদা তার ভেতরকার সব নীরবতা এক নিমিষে ভেঙে দেয়।
সানজিদা ছিল উচ্ছল, প্রাণবন্ত আর ভয়ানক রকম সুন্দর। তার চোখে এক ধরনের আলো ছিল, যা যেকোনো মানুষের ভেতর ঢুকে যেতে পারত। তন্ময়, কাফির সবচেয়ে কাছের বন্ধু, একদিন বলেছিল, “তুই ওই মেয়েটার দিকে এত চেয়ে থাকিস কেন রে কাফি?” কাফি কিছু বলেনি, শুধু হালকা হাসি দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
দিন কেটে যায়, মাস পার হয়। একটা সময় কাফি আর সানজিদার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সানজিদা যখন প্রথম তাকে বলেছিল, "তুই তো আমার কথা কম বলিস, কিন্তু তোর চোখ বলে দেয়, তুই আমার কথা ভাবিস," তখন কাফি বুঝেছিল, ভালোবাসা শুধু বললেই হয় না, সেটা চোখের ভেতর দিয়েও অনুভব করানো যায়।
একদিন সানজিদা তার বান্ধবী রুমির সঙ্গে বসে ছিল লাইব্রেরির বারান্দায়। কাফি দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। রুমি হঠাৎ বলে উঠল, "ওই যে কাফি, তোর পিছনে পাগল।" সানজিদা হেসে বলল, "আমি জানি। ওর চিঠিটা আমি আগেই পড়ে ফেলেছি।"
কাফি অবাক হয়ে গিয়েছিল, কারণ সে কোনো চিঠি দেয়নি। পরে বুঝেছিল, তন্ময় তার লেখা একটা ড্রাফট সানজিদার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
চিঠিতে লেখা ছিল:
"তুই যদি কখনো কাউকে ছাড়া একা হবি, জানিস আমি সেই একাকীত্বের মাঝে থাকতে রাজি। তোর হাসিতে আমি বাঁচি, আর তোর চুপ করে থাকাটাতেই আমি মরে যাই..."
সানজিদা সেই চিঠিটা তার খাতার মধ্যে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। অথচ কিছু বলেনি কাফিকে—না গ্রহণ, না প্রত্যাখ্যান। শুধু প্রতিদিন দেখা, কিছু ছোট্ট কথা, কিছু হাসি।
একদিন হঠাৎ করেই সানজিদা কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। খোঁজ নিয়ে কাফি জানতে পারে, তার পরিবার ঢাকায় চলে গেছে হঠাৎ করেই। ফোন নম্বর, ঠিকানা—কিছুই আর জানা যায় না।
তারপর কেটে যায় চার বছর। কাফি ঢাকায় চাকরি নেয়, জীবনকে ধাক্কা দিতে দিতে কোনোরকমে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই সানজিদা চলে আসে, সেই হেসে ওঠা মুখটা, সেই চুপ করে থাকা সময়গুলো।
একদিন হঠাৎ করেই কাফির হাতে একটা পার্সেল আসে। খুলে দেখে, ভেতরে সেই চিঠিটা, কাফিরই হাতে লেখা, কিন্তু নিচে নতুন করে কিছু লাইন যোগ করা—
"আজও সেই চিঠি আমার খাতায় আছে। আর আমি আজও অপেক্ষা করি, তুই আবার একটা নতুন চিঠি লিখবি কি না... – সানজিদা"
কাফি চুপ করে বসে থাকে। চোখে জল এসে যায়। এতগুলো বছর পরেও কেউ যদি তার লেখা শব্দগুলো বুকের ভেতর ধরে রাখে, তাহলে ভালোবাসা এখনো শেষ হয়নি।
সে রাতেই কাফি নতুন করে একটা চিঠি লেখে। শুধু একটাই লাইন লিখে—
"এইবার আমি আর হারাতে চাই না, তোকে নিয়ে একটা জীবন গড়তে চাই। ফিরবি?"
সে জানে না উত্তর কী হবে, কিন্তু সে জানে... ভালোবাসা চিঠির শব্দে হারায় না।