“স্মৃতির একপাশে তুমি”
হঠাৎই দেখা হয়ে গিয়েছিল তাদের। নয় বছর পর।
কাফি তখন ঢাকায় ছোটখাটো একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করে। ছুটির দিনগুলোয় ঘুরে বেড়ায় শহরের পুরনো অলিগলি, ক্যাফে আর বইয়ের দোকানগুলোতে। সেইদিন ছিল শুক্রবার, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে এক বইমেলার আয়োজন হয়েছিল।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর, “এই তো কাফি?”
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, সামনেই দাঁড়িয়ে তৃষা। স্কুলজীবনের ভালোবাসা। প্রথম প্রেম। প্রথম হাত ধরা। এবং… প্রথম বিদায়।
তৃষার চোখে ছিল চেনা উজ্জ্বলতা, কিন্তু মুখে কিছুটা ক্লান্তি। কাফি একটু হেসে বলল, “তুই এখানে?”
তৃষা হেসে মাথা নেড়ে বলল, “তোর খোঁজে না। নিজের ক্লান্তির বিশ্রামে।”
কাফি কিছু বলল না। ওদের দেখা না হওয়ার নয়টা বছর যেন এক মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লো চোখে-মুখে।
তৃষা চুপ করে বসে পড়ল একটি বেঞ্চে। কাফিও পাশে বসল। এক কাপ করে চা আনিয়ে দিল। কিছুক্ষণ নীরবতা। শুধু পাখির ডাক আর দূরের বইপ্রেমীদের কোলাহল।
তৃষা বলল, “তোর লেখা পড়ি মাঝে মাঝে। ফেসবুকে দেখি।”
কাফি একটু বিস্মিত হয়ে বলল, “তুই তো যোগাযোগ রাখিস না। দেখি না কোথাও।”
তৃষা মৃদু হেসে বলল, “সবাই তো প্রকাশ করে না, কিছু ভালোবাসা দূর থেকেই দেখে।”
কাফির বুকের ভেতর কেমন একটা ঢেউ উঠল। বলল, “কেন তুই হঠাৎ হারিয়ে গেলি, কোনোদিন বলিসনি।”
তৃষার চোখে জল চিকচিক করছিল, সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিল। আমি সাহস পাইনি তোকে কিছু বলার। কাঁদতাম শুধু।”
সেদিনের বিকেল যেন সময় থেমে গিয়েছিল। তারা অনেক কথা বলেছিল। কলেজের গল্প, হুজুরের শাসন, কাফির কবিতা, তৃষার চুপি চুপি দেখা নেওয়া চিঠি…
তৃষা বলল, “তোর এখন বিয়ে হয়নি বুঝি?”
কাফি মাথা নাড়ল, “তোর পর কাউকে আর জায়গা দিতে পারিনি।”
তৃষা এবার কাঁদছিল। বলল, “আমি আজও ভেতরে ভেতরে তোর স্ত্রী হয়ে থাকি। কাগজে না থাকলেও মনের ঠিকানায়।”
তারা আবার উঠল। হাঁটতে লাগল সরোবরের পাশে। কিছুই বলছিল না। শুধু হেঁটে যাচ্ছিল। যেন এটাই তাদের শেষ হাঁটা।
হঠাৎ তৃষা দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাব। আমার মেয়ে অপেক্ষা করছে।”
কাফি একটু থেমে বলল, “তুই ভালো থাকিস।”
তৃষা তাকিয়ে বলল, “তুই তো আমার ভালো থাকাই রয়ে গেলি।”
তারপর সে চলে গেল।
কাফি দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে নিজের লেখা একটা কবিতা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ল—
“ভালোবাসি তোকে বলিনি বলে, তুই জানিস না।
তবুও প্রতি সন্ধ্যায় তোর ছায়াকে চিনি আমি।”