সেই ছোট্ট গ্রামটিতে যতগুলো ঘর, তার মাঝে সবচেয়ে নাজুক আর কাঠের ঘরটিই ছিল আবদুল হকের। বয়স তখন প্রায় পঁয়তাল্লিশের কোঠায়, মুখে হালকা পাকা দাড়ি, গায়ে পানের গন্ধ, পরনে ময়লা লুঙ্গি – শহরের কেউ দেখলে চিনবে না, কিন্তু গ্রামের প্রত্যেকেই জানত – তিনিই “মোবারকের বাবা”।
আবদুল হক সারাজীবন কাজ করেছেন একজন দিনমজুর হিসেবে। সকাল বেলা উঠে খেতে হালচাষ, ইট-বালি টানা, কখনো কখনো রিকশা চালানো – যা পেয়েছেন, তাই করেছেন। তার একটাই স্বপ্ন ছিল –
“সন্তানদের শিক্ষিত করে মানুষ করা।”
নিজে মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়া শেষ করতে পারেননি, কিন্তু জানতেন – বইয়ের জ্ঞানই পারে ভাগ্য বদলাতে।
তিনি প্রায়ই বলতেন,
> “আমার হাড় ভাঙলে চলবে, কিন্তু তোদের কলমটা থেমে যাওয়া চলবে না।”
সংগ্রামের শুরুর গল্প
স্ত্রী রহিমা বেগম, তিন ছেলেমেয়ে – মোবারক (বড় ছেলে), শিরিন (মেয়ে), আর ছোটটা মামুন।
সকালে বের হতেন কাজের খোঁজে, আর সন্ধ্যায় ফিরতেন ক্লান্ত শরীরে। ঘরে ঢুকে সবার আগে জিজ্ঞেস করতেন –
– “পড়ালেখার কী খবর?”
মোবারক একদিন বলেছিল,
– “বাবা, আমার তো হাই স্কুলে ভর্তি হতে হবে। বই কেনার টাকা দরকার।”
বাবা চুপ করে ছিলেন। তারপর রাতে নিজের বহু পুরনো একটা ঘড়ি বিক্রি করে ছেলের হাতে টাকা তুলে দিলেন।
– “তুই বই কিন, আমি সময় না দেখি পারি। কিন্তু তুই পিছিয়ে পরিস না।”
শিরিনের স্কুলের ড্রেস কিনতে মায়ের শাড়ি বন্ধক পড়ল।
মামুনের স্কুল ফিস দিতে নিজের চিকিৎসার টাকা বাতিল করলেন।
রহিমা বেগম প্রায়ই বলতেন,
– “শরীরে আর কত টান দিমু? ছেলেমাইয়ারা বুঝবো তো, কত কষ্ট করতেছো?”
আবদুল হক হেসে বলতেন,
– “ওরা বুঝবে… একদিন ঠিক বুঝবে।”
ছেলে বড় হলো, বাবা ছোট হতে লাগল
বছর কেটে গেল। মোবারক কলেজে ভর্তি হলো। সে মেধাবী ছাত্র, স্কলারশিপ পেয়ে ঢাকায় ভর্তি হলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবার মুখে তখন গর্ব –
“দেখছো আবদুল হকের ছেলে, ঢাকায় পড়তেছে!”
গ্রামে বাবার গর্ব বাড়ছিল, আর শহরে মোবারকের জীবন পাল্টাতে লাগল। নতুন বন্ধু, নতুন ভাষা, নতুন পোশাক।
একবার বাবা ফোনে বলল,
– “বাবা, শীত আসছে। তোকে একটা সোয়েটার পাঠাবো।”
মোবারক বলল,
– “না বাবা, পুরান স্টাইলের না পাঠায়েন। আমি কিনে নেব।”
বাবা একটু চুপ করে ছিল, তারপর বলল,
– “ভালো… কিনে নিস।”
এরপর বাবা দুইদিন না খেয়ে থেকে ছেলের জন্য মানসম্মত জ্যাকেট কিনে পাঠাল।
কিন্তু মোবারক সে জ্যাকেট কখনো পরেনি।
ছেলের চাকরি, বাবার অবহেলা
মোবারক পড়াশোনা শেষে চাকরি পেল ঢাকার এক নামী প্রতিষ্ঠানে। বেতন মোটা অঙ্কের। এরপর শুরু হলো তার শহুরে জীবন – ফ্ল্যাট, বাইক, নতুন পোশাক, আধুনিক বন্ধু, নতুন চিন্তা।
গ্রামে বাবা সেই পুরনো ভাঙা ঘরেই থাকতেন। মায়ের ডায়াবেটিস, ছোট ভাইয়ের টিউশনি – সবই চলছিল বাবার কাঁধে।
একদিন বাবা ফোনে বলল,
– “বাবা, তোর ছোট ভাই মামুনের কলেজে ভর্তি লাগবে। কিছু টাকা যদি পাঠাস…”
মোবারক বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
– “বাবা, আমি কি ব্যাংক হয়ে গেছি? কিছুদিন পর বলবেন বাড়ি মেরামতের জন্যও টাকা দেন।”
বাবা হাসলেন না, বললেনও না কিছু। শুধু বললেন –
– “ভালো থাকিস বাবা। আমি ভাবছিলাম তুই বুঝবি…”
বাবার অসুখ, কারও সময় নেই
একদিন হঠাৎ আবদুল হক মাঠে কাজ করতে গিয়ে পড়ে গেলেন। ডাক্তার বলল, হার্টের সমস্যা। জরুরি চিকিৎসা দরকার। মা ফোন করলেন মোবারককে –
– “বাবারে, তোর আব্বার অবস্থা ভালো না। একটু আয় না।”
মোবারক তখন অফিসের ট্রিপে চট্টগ্রাম। বলল –
– “মা, আমি ব্যস্ত। একটা বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। টাকাপয়সা লাগলে জানাও, লোক পাঠিয়ে দেব।”
কিন্তু ততক্ষণে আবদুল হকের মুখে একটিই কথা –
– “ছেলেকে একবার দেখতে চাই…”
শেষমেশ, তিনদিন পর মোবারক গ্রামে ফিরল। কিন্তু তখন সব শেষ।
বাবা নেই।
বিছানায় পড়ে আছে বাবার ছেঁড়া গামছা, মাথার নিচে পুরনো বালিশ, আর কোণের টেবিলের উপর একটা পুরনো চিঠি।
মোবারক হাতে তুলে নিল চিঠিটা।
---
> **"বাবা,
জানি, তোকে বোঝাতে পারিনি আমি কতটা ভালোবাসি। শুধু চাইতাম, তুই কষ্ট না করিস।
অনেক সময় ভাবতাম, তোকে বলি – আমারও তো শরীর ক্লান্ত হয়, বুক ধড়ফড় করে, পায়ে ব্যথা হয়। কিন্তু বলিনি… কারণ তোর জন্য আমি সব পারি।
তোকে নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু মন চায়, তুই মাঝে মাঝে এসে বলিস – ‘বাবা, খাইছো?’
তোদের জন্য আমি নিজের জীবনটাকেই উৎসর্গ করেছিলাম। আজ আমার কিছু চাওয়া নেই… শুধু এইটুকু বিশ্বাস রাখিস,
তোর বাবা কখনো অভিমান করেনি – ভালোবেসে গেছে আজীবন।
– তোর আব্বা।"
---
চোখের পানি মোবারকের গাল ভিজিয়ে দিল।
বাবা মারা যাওয়ার পর সে অনেক বড় বাড়ি বানালো, মা-ভাইকে শহরে এনে রাখল, বিদেশ ভ্রমণ করল – কিন্তু সেই “বাবা” শব্দটার বিকল্প আর কখনো পেল না।
শেষ দৃশ্য
মোবারক এখন নিজেই বাবা। তার ছোট্ট মেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করল –
– “বাবা, দাদুকে কখন দেখব?”
মোবারক চুপ করে ছিল। শুধু মাথার ওপর বাবার একটা ছবি টাঙানো।
নিচে লেখা –
“আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক, যিনি বলেছিলেন – নিজের কিছু না রেখে ভালোবাসা দাও।”
---
গল্পের শিক্ষা
👉 বাবা-মা চিরকাল থাকবে না।
👉 তারা টাকা চায় না, চায় সময়, সম্মান আর ভালোবাসা।
👉 একজন বাবা সারাজীবন শুধু দেয় – বিনিময়ে কিছু চায় না।
👉 সন্তান যত বড়ই হোক না কেন, সে কখনো বাবার ঋণ শোধ করতে পারবে না
Md Joynal abedin
Slet kommentar
Er du sikker på, at du vil slette denne kommentar?