ব্যর্থ জীবন
জীবনের পথে সবাই সাফল্যের আলো খুঁজে বেড়ায়। কেউ খুঁজে পায়, কেউবা হোঁচট খেয়ে থেমে যায়। এই গল্পটা এমন এক মানুষের, যার জীবনের অধ্যায়গুলো সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার আঁধারেই বেশি রঙিন।
শুরুটা
রফিক ছোটবেলায় ছিল খুব মেধাবী। গ্রামের স্কুলে সবাই তাকে ডাকত “বিদ্যাধর” বলে। শিক্ষকরা বিশ্বাস করতেন, একদিন সে বড় মানুষ হবে। তার চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন—ডাক্তার হবে, বাবাকে গরিবি থেকে মুক্তি দেবে, মাকে একটা পাকা ঘরে রাখবে।
কিন্তু স্বপ্নের পথে যতই এগোতে লাগল, ততই জীবনের কঠিন বাস্তবতার দেয়ালে ধাক্কা খেল। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারল না টাকার অভাবে। বাবার সামান্য চাষাবাদের আয়ে সংসার চলত কষ্টে। রফিক চাকরির আশায় ঢাকা গেল।
সংগ্রাম
ঢাকায় এসে প্রথমেই বুঝল—গ্রামের স্বপ্ন শহরে টিকে থাকে না। কাগজে ছাপা চাকরির বিজ্ঞাপন পড়ে দৌড়াদৌড়ি করল, সাক্ষাৎকার দিল, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে বা পরিচয়ের ঘাটতিতে কোথাও টিকতে পারল না।
টিউশনি করে দিন চলল। কিন্তু সেখানে-ও প্রতিযোগিতা, দালালির খেলা। মাস শেষে অল্প টাকায় চলা কঠিন হয়ে উঠল। অনেক রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমোতে হয়েছে তাকে।
বন্ধুরা কেউ বিদেশে চলে গেল, কেউ সরকারি চাকরিতে ঢুকে গেল, কারও ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল। অথচ রফিকের দিন কাটে একখানা ফাঁকা রুমে, ভাঙা খাটে শুয়ে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে।
প্রেমের অধ্যায়
রফিকের জীবনে আলো এনেছিল এক মেয়ে—শিলা। সে-ই তাকে বলত, “তুমি একদিন পারবেই।” শিলার চোখে রফিক ছিল আলাদা। কিন্তু পরিবার চাইল ধনী পাত্র। রফিক কিছুই দিতে পারল না। শেষমেশ শিলার বিয়ে হয়ে গেল এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে।
এই আঘাত রফিককে ভেঙে দিল ভেতর থেকে। সে আরও একা হয়ে গেল। জীবনের প্রতি আস্থা হারাতে লাগল।
ব্যর্থতার ঘূর্ণিঝড়
রফিক কয়েকবার ছোটখাটো ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিল—মোবাইলের দোকান, চা-স্টল, বই বিক্রি। কিন্তু হয় প্রতারণার শিকার হয়েছে, নয়তো লোকসানে বন্ধ করতে হয়েছে।
চাকরির চেষ্টা চলল অবিরত। বয়স যত বাড়ল, সুযোগ ততই কমে এল। একসময় সরকারি চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে গেল। প্রাইভেট সেক্টরে অভিজ্ঞতা না থাকায় সেখানেও আর কেউ নিতে চাইত না।
যে মানুষ একদিন বড় স্বপ্ন দেখত, সে এখন বেঁচে থাকার জন্য রিকশা চালায়। প্রতিদিন ভোরে রিকশা নিয়ে বের হয়, রাতে ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসে।
সমাজের দৃষ্টি
গ্রামে গেলে মানুষ তাকে ব্যর্থ বলে। কেউ বলে—“এত পড়াশোনা করে রিকশা চালাচ্ছে!” কেউ হাসাহাসি করে, কেউ করুণা দেখায়। রফিক আর গ্রামে যেতে চায় না। সে জানে, ব্যর্থ মানুষকে সমাজ কখনো ক্ষমা করে না।
মনের যুদ্ধ
রফিক অনেক রাত একা বসে ভাবে—“আমি কোথায় ভুল করলাম? কেন আমি কিছুই পারলাম না?” তার বুকের ভেতর এক অদৃশ্য ব্যথা জমে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু শেষ করে দেয়।
কিন্তু আবার ভাবে—“না, আমি বেঁচে আছি মানে এখনো লড়াই শেষ হয়নি।”
জীবনের শেষ অধ্যায়
বছর কেটে যায়। রফিক এখন মধ্যবয়সী। শরীর আগের মতো শক্তিশালী নেই। তবুও প্রতিদিন রিকশা চালায়, কারণ তার পেট তো আর থেমে নেই।
কোনো পরিবার গড়তে পারেনি। শিলার স্মৃতি এখনও মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু সে এখন অন্য কারও স্ত্রী, সন্তানের মা।
রফিকের ঘরে কেউ নেই। একাকিত্বই তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী।
উপলব্ধি
একদিন রিকশা চালাতে চালাতে সে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে দাঁড়াল। দেখল, কিছু তরুণ-তরুণী হাসিমুখে বের হচ্ছে। ওদের চোখে ছিল সেই স্বপ্ন, যেটা একসময় তার চোখেও ছিল।
রফিক মনে মনে বলল, “তোমরা ভাগ্যবান। আমার মতো যেন ব্যর্থ না হও।”
উপসংহার
রফিকের জীবন এক ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু এই ব্যর্থতার মধ্যেও একটা শিক্ষা আছে—জীবন সবসময় ন্যায্য নয়। সবার ভাগ্যে সাফল্য লেখা থাকে না।
কখনো কখনো ব্যর্থ জীবনও অন্যদের জন্য শিক্ষা হয়ে ওঠে। রফিক হয়তো বড় কিছু হতে পারেনি, কিন্তু তার গল্প অন্যদের শেখায়—স্বপ্ন ভাঙলেও মানুষ বেঁচে থাকে, লড়াই করে, টিকে থাকে।,,,,,,,,,