আমার ছোটবেলায় বাবা তার বন্ধু নিরুপম জেঠু কে কথা দিয়েছিল যে তার একমাত্র কন্যার সাথে অর্থাৎ আমার সাথে নিরুপম জেঠুর একমাত্র পুত্রের বিবাহ দেবে। কথা মতোই ঠিক যখন উনিশ বছরে পা দিলাম সবে মাত্র প্রেম ভালোবাসার গল্প পড়তে শুরু করলাম, আশেপাশে প্রেমিক যুগল কে দেখে মনে প্রেমের ইচ্ছেরা বাসা বাঁধতে শুরু করলো ঠিক তখনই আমার সব ইচ্ছার অবসান ঘটিয়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো অনুপমদার সাথে। ছোটবেলা থেকেই অনুপমদা কে চিনতাম তবে একদিন যে ওর সাথেই আমার বিয়ে হবে সে কথা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। অনুপমদা বোধহয় জানতো সে কথা। যাইহোক, বিয়ের পরেরদিন কেঁদে-কেটে বিদায় জানালো আমাকে আমার এতদিনের সম্পর্কগুলো। আমিও সমাজের নিয়ম মেনে মা বাবার ঋণ তিন মুঠো চাল ছুড়ে দিয়ে শোধ করে বিদায় নিলাম।
বিয়ের পর যে বার প্রথম আমি আর অনুপম এক হলাম, যে মুহূর্তে অনুপম আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো সেদিন ভেবেছিলাম হয়তো এটাই ভালোবাসা। অনুপম অফিস যাওয়ার পর সারাদিন কাজের ফাঁকে অনুপমের অপেক্ষা করতাম। কখনো বা আগের রাতের আদরের কথা ভেবে আপন মনে লজ্জা পেতাম। অনুপমের শার্ট নিয়ে সেই শার্টের পারফিউমের গন্ধে নিজেকে ডুবিয়ে দিতাম। সন্ধে বেলায় যখন অনুপমের ফেরার সময় হত তখন চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, আরো কত কি দিয়ে সাজিয়ে তুলতাম নিজেকে। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অনুপমের চোখ থেকে দেখতে ইচ্ছা হতো। ঠিক যখন মগ্ন হতে শুরু করেছি ভালোবাসার মধ্যে তখনই এক দুপুরে খবর পেলাম যে আমি অন্তঃসত্ত্বা।
সত্যি বলতে খবর টা শুনে খুশির থেকে ভয় বেশি পেয়েছিলাম।
আমি কি পারবো? এই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরপাক খেয়ে যেত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। তবে এক সন্ধ্যায় যখন ভিতরে এক নিষ্পাপ প্রানের বেড়ে ওঠার আভাস পেলাম সেদিন বুঝলাম ভালোবাসা কি। অনুপম তখন তার অফিসের সহকর্মী সোমা কে নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত হওয়াটাও স্বাভাবিক আমার কাছ থেকে তার যা চাওয়া তা আপাতত তার পাওয়া হচ্ছিল না। একদিন অনুপম ঘুমিয়ে পড়ার পর তার ফোনে "গুড নাইট হানি। লাভ ইউ।" মেসেজটা আসতে দেখে জানতে পারি সে কথা। তারপর থেকে এরকম অনেক ভাবেই সামনে এসেছে অনুপমের পরকীয়ার সত্যি। তাতে যদিও আমার খারাপ লাগেনি কারণ ততদিনে আমার ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলেছে। আমার কাছে ভালোবাসা মানে তখন আমার মধ্যে বেড়ে ওঠা সেই ছোট্ট প্রাণ।
বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন আমার কোল আলো করে জন্ম নিলো আমার ছেলে অভিরাজ। মিথ্যে বলবো না তবে মা হওয়ার পর বুঝতে পারলাম ত্যাগ কি জিনিস। রাত বিরেতে নিজের ঘুম ত্যাগ করে সন্তানের জন্যে জেগে থাকা, গরম জলে সন্তান কে স্নান করানোর আগে সেই জলে নিজের হাত যে কতবার পুরিয়েছি তা খেয়াল নেই। সন্তানের আধ খাওয়া খাবার খেয়ে কত বেলা পেট ভরিয়েছি। নিজের জন্য শাড়ি কেনবার টাকা দিয়ে যখন অভি কে রিমোটের গাড়ি বা কোনো রোবট কিনে দিতাম ওর মুখের হাসিটার মধ্যে ভালোবাসা খুঁজে পেতাম। তবে সে ভালোবাসাটাও বেশিদিন টিকলো না। যে বার স্কুলে খারাপ রেজাল্ট করায় ছেলেকে বকে ছিলাম সেই বার অনুপম বলেছিলো "আমার ছেলে কে একদম বকবে না। ওর যেমন ইচ্ছা ও তেমন ভাবে চলবে।" তা শুনে অভি ও বলেছিল, "আমার বাবা সবচেয়ে ভালো।"
না তারপর থেকে অনুপমের ছেলে কে আর কোনো কিছুই বলিনি। নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলাম সকলের থেকে। একদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে নেমবুক ঘাটছি হঠাৎ একটা মেসেজ এলো 'হাই, তোকে আজ দেখলাম। ভালো লাগছিলো অনেকদিন পর দেখে।' অচেনা কেউ না যদিও স্কুলে পড়াকালীন একসাথেই পড়তো নাম -ঋজু বিস্বাস। ছোটবেলায় খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের সকলের। আজ আর তেমন বন্ধু কই। যাক উত্তর না দিলে খারাপ দেখায় তাই পাঠালাম, 'ওহ কোথায় দেখলি?'
উত্তর এলো- 'একটা খেলনার দোকানে।'
মনে পড়লো অভির জন্মদিন সামনে তাই ওর জন্য উপহার কিনতে গিয়েছিলাম। তখনই দেখেছে বোধহয়। আবার মেসেজ আসলো, 'আচ্ছা তোকে দেখে আগের মতো আর হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল লাগলো না। তোর জীবনে কি কোনো সমস্যা আছে?'
হাত লিখতে চাইলো সমস্ত মনের কথা তবে 'না তেমন কিছুই না রে।' এই শব্দগুলি ছাড়া আর কিছুই লিখে উঠতে পারলাম না। সেদিনের মতো আর কথা হলো না তবে পরেরদিন আবার যেই রাতে নেমবুকে ঢুকলাম অমনি মেসেজ আসলো,
'কেমন আছিস?'
লিখলাম, 'ভালো তুই কেমন আছিস?' এই ভাবেই কথা হতে থাকে প্রায় প্রতিদিন। জানতে পারলাম ঋজু এখন নাম করা এক কোম্পানী তে চাকরি করে। মা, বাবা এবং দিদির সাথে থাকে। ঋজুর বাড়ি আমার বাবার বাড়ির পাশের পাড়ায়। খুব বেশি দুরত্ব না। আমার বৈবাহিক জীবনের যখন সাত বছর পূরণ হতে চলেছে তখনও ঋজু অবিবাহিত। কয়জন পুরুষই বা আমাদের মতো কম বয়সে বিয়ে করে। সে যাইহোক আমাদের এই প্রতিদিন রাতের কথাবার্তাগুলো কেমন যেন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে লাগলো আমার কাছে।
আসতে আসতে সেই রাতের কথোপকথনগুলো সারাদিনের হিসেব-নিকেশে বদলে গেল। আমরা একে অপরের সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে উঠলাম নিজেদের অজান্তেই। তবে এইবারের ভালোবাসাটায় কারুর কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না ছিল শুধু একটাই ইচ্ছা যাতে অপরজন ভালো থাকে। এক দু বার দেখা করেছি বাইরে তবে ঋজু কখনো আমার হাতটা ও ধরেনি। এই ভালোবাসাটা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে নিঃস্বার্থ হয়ে ভালোবাসা যায়। ঋজু প্রতিটা মুহূর্তে আমার ভালো থাকার কথাই মাথায় রাখতো। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো তখন লুকিয়ে কখনো ছাদে বা কখনো বারান্দায় ফোনে গল্প করতাম আমরা দুজন। সে গল্পের বেশিরভাগই থাকতো আমাদের স্কুলের বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে। এই ভালোবাসাটা নিয়ে আমি দিব্যি সুখে ছিলাম বুঝেছিলাম ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ তবে ঠিক তখনই ঋজুর বাড়ি থেকে ওর জন্য বিয়ে ঠিক করা হলো। ঋজু কি করবে জানতে চাইলে আমিই তাকে বিয়েটা করে নিতে বলি কারণ ততদিনে আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা খুবই পরিষ্কার।
'একজন মানুষকে ভালোবাসলে তাকে নিজের করে পেতে হয়না। মনে ভালোবাসার অনুভূতি থাকলেই তাকে পাওয়া যায় কখনো ভাবনায়, কখনো শব্দে, কখনো নিস্তব্ধতায়, কখনো স্বপ্নে বা কখনো কোনো গানের লাইনে।'
#story