রাজস্থানের কোর্টের রায় শুনে আমি নিজেই খানিকটা চমকে উঠেছিলাম। প্রচণ্ড নারী-বিরোধী ঐতিহ্য আর সনাতন সংস্কৃতি যেখানে রমরমা, কী করে রাজস্থানের মতো একটি রাজ্যে, যেখানে নারীর স্বাধীনতা অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক কম, ঘোষিত হয় এই রায়, যে, স্বামীর অনিচ্ছাসঙ্গে্েবও প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বসবাস করার অধিকার রাখে! অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটি ঘটেছে। মঞ্জু নামের মেয়ে এখন বাস করছে তার প্রেমিক সুরেশের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গে নয়। হাই কোর্টের দুজন বিচারক জিসি মিশ্র এবং কেসি শর্মা এই রায় দেন, যে, মেয়েদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার অধিকার থাকা কারওরই উচিত নয়।
বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির গায়ে এই রায় বড় একটি আঘাত বটে। কোনও প্রতিষ্ঠানই এতকাল এত মারমার কাটকাট চলেনি, বিবাহ যেমন চলেছে। কোনও প্রতিষ্ঠানে চিড় ধরে, ভাঙে, আবার হয়তো টিমটিম করে কিছুদিন জ্বলে, একসময় ধপ করে নিভে যায়। বিবাহের টিমটিম নেই, নিভে যাওয়া নেই। হিপি আমলে সেই ষাটের দশকে একবার লালবাতি জ্বলেছিল বটে, সেও পুবে নয়, পশ্চিমে। পশ্চিমের ছেলে মেয়েরা বিয়ে করা বন্ধ করেই দিয়েছিল। সেই লালবাতি আশির দশকে এসে সুবজ হতে শুরু করলো। রক্ষণশীলতা পা পা করে ইওরোপের দিকে দৈত্যের মতো এগোলো। পুবে তো দৈত্যদের বরাবরই জয়জয়কার।
এই পুবে, এই ভারতবর্ষে বসে কিনা আজ শুনছি আদালত বলছে, ‘কোনও মেয়েকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারও সঙ্গে বাস করার জন্য জোর করা উচিত নয়।’ সময় যেন হঠাৎ করে একশ বছর এগিয়ে গেছে। আসলে তো কিছুই এগোয়নি। রায়টি বরং এই সমাজের চরিত্রের সঙ্গে বদ্দ বেমানান। দেশের কোনও একটি আদালতে কোনও এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিচারক হঠাৎ একটি চমৎকার রায় দিয়ে দিলেন, এই সমাজের কিছুর সঙ্গেই যে রায়টি মেলে না, তাতে নেচে ওঠার কিছু কি আছে? যে মঞ্জু আজ প্রেমিকের সঙ্গে বাস করছে, সেই মঞ্জু কি আদৌ একফোঁটা স্বস্তিতে আছে? তাকে লোকেরা অকথ্য ভাষায় দিন রাঙ্গির গালি গালাজ করছে না? সামনে পেলে পিটিয়ে তার লাশ ফেলে দেবে, হুমকি দিচ্ছে না? নষ্ট মেয়ে, খারাপ মেয়ে, অসতী, বেশ্যা এসব কি উঠতে বসতে বলছে না? আমরা খুব সহজে অনুমান করতে পারি, যে, ভয়ংকর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কুঁকড়ে আছে মঞ্জু। এ অবস্থায় সে নিশ্চয়ই সামান্যও উপভোগ করতে পারছে না তার প্রেমের জীবন। সুরেশের প্রেমও কি বেশিদিন টিকে থাকবে! অন্যের ‘বিয়ে করা’ বউকে ঘরে তোলার জন্য তাকে কি কম বিদ্রুপ সইতে হচ্ছে! পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন নিশ্চয়ই ছি ছি করছে। মানুষ আর কদিন বাস করতে পারে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্যে? মেয়েরা না হয় পারে, অভ্যেস আছে। সারাজীবন এসব সইতেই তাদের সারাজীবন শেখানো হয় । কিন্তু পুরুষ তো বুক ফুলিয়ে চলার জন্য যা দরকার সবই করবে। পুরুষ-সুরেশ অসুবিধে দেখলে প্রেমিকের খোলশ থেকে যে কোনও মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। সুরেশ যদি ত্যাগ করে মঞ্জুকে? মঞ্জু তখন কার আশ্রয়ে যাবে? হয় স্বামী-পুরুষটির কাছে ফিরে যাবে, নয়তো অন্য কোনও নতুন প্রেমিক-পুরুষের আশ্রয়ে। এছাড়া আর কী! নারীর সমস্যার এ কি সত্যিই কোনও সমাধান, যখন তাকে এক পুরুষের আশ্রয় থেকে আরেক পুরুষের আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়? তার চেয়ে নারীর যদি কারও আশ্রয়ের প্রয়োজন না হত, নিজেই নিজের জন্য সে যথেষ্ট হত! কারও করুণার তোয়াত্তা না করে যদি সে বেঁচে থাকতে পারতো, নিজের আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে, দুর্বিনীত এবং দুঃসাহসী!
যে সমাজে একটি মেয়ের শিক্ষা , স্বাস্থ্য, সম্মান কিছুই জরুরি বিষয় নয়, মেয়ের ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই, অন্যের ইচ্ছেয় বিশেষ করে পুরুষের ইচ্ছেয় জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যাপন করতে হয় একটি মেয়েকে, সেখানে কোনও একটি রাজ্যের আদালতের রায় একটি মেয়ের জীবনের কী এমনই-বা পরিবর্তন করতে পারে! সমাজ তো আছে আগের মতোই, আগের মতোই নারীবিদ্বেষী।
তলিয়ে দেখলে মঞ্জুর তার স্বামীর কাছে থাকা, বা প্রেমিকের কাছে থাকা—একই জিনিস। দুজায়গাতেই সে আশ্রিতা। দুজায়গাতেই তাকে নিঃশর্তভাবে নিবেদন করতে হবে তার সর্বস্ব। পুরুষদের ইচ্ছে হলে মঞ্জুকে লাথি দেবে, ইচ্ছে হলে চুমু