পকেটমার
স্টেশন চত্বর সবসময়ই ছিল সজলের কর্মক্ষেত্র। বয়স পঁচিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু অভ্যাসটা পুরোনো—পকেট মারার। ভিড়ের ভেতর হাত চালানো, চোখে পড়ার আগেই মিশে যাওয়া, এসব তার কাছে জলভাত। তার মতো মানুষদের কেউ চেনে না, জানতেও চায় না।
একদিন দুপুরে স্টেশনের ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রচণ্ড ভিড়। দূরের ট্রেনটা তখনই থেমেছে। সজলও ছিল দলে। লক্ষ্য—একজন বৃদ্ধ। তার সাদা ধুতি, ঘামভেজা গামছা আর হঠাৎ থেমে যাওয়া হাঁটা—সবই তাকে সহজ টার্গেট করে তোলে। সজলের হাতটা ধীরে ধীরে বৃদ্ধের পকেটে চলে যায়। পকেট থেকে একটা পুরনো মানিব্যাগ টেনে নেয় সে।
পেছনে না তাকিয়েই হেঁটে চলে আসে প্ল্যাটফর্মের এক কোনায়। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ খুলে দেখে—ভেতরে মাত্র ৫০ টাকা আর একটা ভাঁজ করা চিরকুট। মুখটা কুঁচকে উঠে। এমন লোকের পকেটে এর বেশি থাকবে না, সেটা সে জানত। কিন্তু কৌতূহলবশত চিরকুটটা খুলে দেখে।
লেখা:
“আজ রাহেলের ওষুধ আনতেই হবে। জ্বরটা বাড়ছে। এই টাকা দিয়ে এক বোতল প্যারাসিটামল আর এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে ফিরতে হবে। - দাদু”
সজলের গা শিউরে উঠে। ‘রাহেল’ নামটা পড়ে তার বুক কেঁপে যায়। ছোটবেলায় তারও এমনই জ্বর হয়েছিল, কিন্তু টাকা না থাকায় মা ওষুধ কিনতে পারেনি। আর সেই রাতেই মারা যায় সে মা। সেই রাত থেকে সজলের জীবনের সব আলো নিভে যায়।
আজ অনেক বছর পর সেই একই গল্প আবার সামনে। কাঁপা হাতে ব্যাগটা নিয়ে সে দৌড় দেয় স্টেশন চত্বরে। কয়েক মিনিট খুঁজে বৃদ্ধটাকে খুঁজে পায় প্ল্যাটফর্মের এক কোনায়, হতাশভাবে বসে থাকা অবস্থায়।
“চাচা, আপনার ব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল,”—বলে মানিব্যাগটা বাড়িয়ে দেয় সজল। বৃদ্ধের চোখে জল চলে আসে। “আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক, বাবা,”—বলেন তিনি।
সজল কিছু বলে না, শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের কোণে পানি জমে, কিন্তু সে পেছন ফিরে না তাকিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায়।
সেদিন রাতে সে প্রথমবার ভাত খাওয়ার আগে নিজেকে আয়নায় দেখে। পকেটমার নয়, সে নিজেকে একবারের জন্য মানুষ মনে করেছিল।
#sifat10