গল্প: “সাঁতারে জেতার দিন”
আমার নাম রফিক। বয়স তখন বারো। আমি থাকতাম জামালপুরের এক ছোট্ট গ্রামে—চরপাড়া। আমাদের বাড়ির পেছনে বিশাল একটা খাল ছিল। বর্ষাকালে সেই খাল টইটম্বুর হয়ে উঠত, আর আমরা ছেলেরা দল বেঁধে সাঁতার কাটতে যেতাম।
আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল “বর্ষার সাঁতার প্রতিযোগিতা।” প্রতি বছর আষাঢ় মাসে আয়োজিত হতো, ঠিক ঈদের আগের শুক্রবারে। গ্রামের মাঠে মাইক বাজত—“আগামী শুক্রবার চরপাড়া সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। অংশগ্রহণকারীদের নাম কালকের মধ্যেই দিতে হবে স্কুল মাঠে।”
আমি তখন নতুন সাঁতার শিখেছি। ডুবে না গেলেও ঠিক ভরসা ছিল না নিজের ওপর। কিন্তু বন্ধু রাজু বলল, “তুই নাম দে রফিক, তোর ভরসা না থাকলেও, আমার আছে!” আমি হেসে বললাম, “তুই কী আমার কোলে করে পার করবি?” রাজু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “দেখিস না, সাঁতার তো গায়ের জোরে না, মনের জোরে!”
আমি নাম দিয়ে দিলাম। সেই কদিন ঘুম হারাম হয়ে গেল। রাজু আর আমি প্রতিদিন বিকেলে খালে নামতাম। মা চিৎকার করতেন, “বৃষ্টি হচ্ছে রে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে!” কিন্তু আমি শুনতাম না। মনে মনে ভাবতাম—জিতলে সবাই তাকিয়ে দেখবে, মা গর্বে বলবে, “ওই যে, আমার ছেলে!”
যেদিন প্রতিযোগিতা হলো, সারা গ্রাম যেন মাঠে ভিড় করেছিল। আমাদের সাঁতারের লাইনটা ছিল খালের এক পাশ থেকে আরেক পাশে। মুরুব্বিরা বাঁশের খুঁটি গেঁথে রেখেছিল সীমা নির্ধারণ করতে। আমি রাজুকে দেখে সাহস পেলাম, সে চোখ টিপে বলল, “চলো, উড়াল দেই!”
সুইসির আওয়াজে সবাই ঝাঁপ দিলাম। প্রথমে মনে হচ্ছিল বুক ফেটে যাবে, কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ যেন শরীরে সাহস এসে গেল। শেষ মুহূর্তে আমি রাজুকে ছুঁয়ে ফেললাম—একসাথে শেষ করলাম!
আমাদের দুজনকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হলো। গ্রামের মোড়ল সবার সামনে আমাদের হাতে তুলে দিলেন লাল রঙের গামছা আর এক প্যাকেট বিস্কুট। আমার চেয়ে খুশি ছিল মা। বললেন, “আমার রফিক যে সাঁতারু হবে, আগে বুঝিনি!”
আজ আমি শহরে থাকি, কলেজে পড়ি। কিন্তু যখন বৃষ্টি নামে, চোখ বন্ধ করলেই খালের সেই ঠাণ্ডা জল, রাজুর চোখ টিপ, আর লাল গামছার গন্ধ ফিরে আসে। গ্রাম ছাড়া মানুষ বড় হয় বটে, কিন্তু বড় হওয়ার গল্পটা সবসময় গাঁ থেকেই শুরু হয়।
mahfuz24122007
Tanggalin ang Komento
Sigurado ka bang gusto mong tanggalin ang komentong ito?