আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রধান রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নানাভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনে তিনি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন এবং পরবর্তীকালে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে নিজস্ব রীতিতে গদ্যচর্চা করেন। উনিশ শতকের মানবতাবাদে যেমন, বাংলা গদ্যের সার্থক শিল্পরূপ নির্মাণের ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। রামমোহন বাংলা গদ্যের কাঠামো তৈরি করেন, আর বিদ্যাসাগর তাতে প্রাণসঞ্চার ও সৌন্দর্য সংযোজন করেন। বিদ্যাসাগরের রচনাকে চারটি ধারায় ভাগ করা যায়: সমাজবিষয়ক রচনা, রম্যরচনা, পাঠ্যপুস্তক ও সাহিত্যধর্মী রচনা। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য বাংলা গদ্যে সাবলীল গতিভঙ্গি তথা অন্তর্নিহিত ছন্দ আবিষ্কার এবং বিরামচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার। উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের প্রধান পরিকল্পনাকারী ও নিয়ন্ত্রক ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি বাংলা সাধুগদ্যের একটা আদর্শ রূপ দেন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালের লেখকগণ অনুপম সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
প্রবন্ধের সুসংবদ্ধ বক্তব্যের জন্য উপযুক্ত গদ্য রচনা করেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪)। তাঁর রচনার বিষয় সমাজ, শিক্ষা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি; আর এ কারণেই রচনার শিথিল ভঙ্গি তাতে গ্রাহ্য হয়নি। এ সময়ের অন্যতম প্রধান পন্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (১৮২২-১৮৯১) অধিকাংশ রচনা ইংরেজিতে হলেও বাংলায় তিনি খ্যাত মাসিক পত্রিকা বিবিধার্থ সংগ্রহ (১৮৫১), রহস্যসন্দর্ভ (১৮৫১) ও বিবিধার্থ সংগ্রহ সন্দর্ভ-এর (১৮৬৩) জন্য। প্রথমটিতে সূচনা হয় গ্রন্থ সমালোচনার। এ ধারায় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭) ১৮৫২ সালে প্রকাশ করেন বাংলার প্রথম সাহিত্য সমালোচনামূলক একটি গ্রন্থ। রাজনারায়ণ বসুর সেকাল আর একাল (১৮৭৪), হিন্দু কলেজ অথবা প্রেসিডেন্সি কলেজের বৃত্তান্ত (১৮৭৬), বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮) এবং আত্মচরিত-এ (১৯০১) পাওয়া যায় মননশীলতার গভীর পরিচয়। রামগতি ন্যায়রত্ন (১৮৩১-১৮৯৪) বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিস্তৃত ইতিহাস বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭২, ১৮৭৩) রচনা করেন। পাঠ্যপুস্তকের লেখক মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮) বিদ্যাসাগর পর্বের একজন উল্লেখলযোগ্য লেখক ছিলেন।