"সহস্র দিনের ছায়া"
(এক দীর্ঘ কাব্য, জীবন ও কল্পনার সংলগ্ন নদীতীরে)
একটি নদী ছিল — নাম জানে না কেউ,
সে শুধু বয়ে চলে, কথা বলে জলে।
তার গোপন ভাষা ছুঁয়ে যায় পাথরে,
সে নদীই ছিল আমার প্রাচীন কলমের ছলে।
বালুকার স্তূপে বসে লিখতাম স্বপ্ন,
ভোরবেলা সূর্য জেগে উঠত আমার ছন্দে।
যেখানে বাতাসে গন্ধ থাকত স্মৃতির,
যেখানে শিশির কাঁদত পত্রের অরুণ বর্ণে।
আমি এক পথিক, অনন্তের দিকে হাঁটি,
পেছনে ফেলে আসা নগরের ভাঙা ছাদে
রয়ে গেছে কিছু মুখ—অর্ধেক চেনা,
তাদের হাসিতে ছিল অজস্র অভিমান,
আর চোখে শীতল নিরবতার ছায়া।
আমার শহরে ছিল না কোনো দিগন্ত,
ছিল কেবল ইঁট আর ধোঁয়া,
কিন্তু আমি দেখতাম—এক আকাশ ফুঁড়ে
উঠে আসছে অদেখা নীহারিকা।
আমি কবি ছিলাম না, আমি ছিলাম শ্রোতা।
শোনার চেষ্টা করেছি পাতার নীচে পিঁপড়ের ভাষা,
গন্ধরাজ গাছের আত্মকথা,
নক্ষত্রের নিঃশব্দ নীল অভিসার।
আমি দেখেছি একা চাঁদের চোখে
প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস,
সে চাঁদ যে হেঁটে গিয়েছিল
আমার ছাদ থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত,
পায়ে পড়েছিল ফাল্গুনের হলুদ কুর্তা।
একদিন বর্ষা নামে,
জলরঙ ছড়িয়ে দেয় চারদিকে,
আমি সে জলে ভাসিয়ে দিই আমার পুরোনো কবিতা,
যারা ফিরে আসে না কখনো,
শুধু ঢেউ হয়ে বাজে হৃদয়ের দেয়ালে।
আমি লিখি প্রেম নিয়ে, অথচ জানি না প্রেম কাকে বলে,
সে কি চোখের ভেতর লুকানো লজ্জা?
নাকি অন্ধকারে দুই হাত ধরে হাঁটা?
নাকি কোনো এক বিকেলে হঠাৎ ছায়ার নিচে দাঁড়ানো?
আমি এক নারীর কণ্ঠ শুনেছিলাম —
যার নাম ছিল ইতিহাস,
তার চোখে ছিল এক যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ,
আর ঠোঁটে লেগে থাকা অসমাপ্ত বিপ্লব।
সে বলেছিল, “তুমি যদি কবি হও,
তবে আমার যন্ত্রণা লিখে রাখ পাথরে,”
আমি লিখেছিলাম—
কিন্তু পাথরও কাঁদে একসময়,
ভিজে ওঠে রক্তের অক্ষরে।
কখনো আমি এক কৃষকের পাশে বসে শুনেছি—
সে কি করে ধানগাছের সাথে কথা বলে,
কীভাবে মাটির চোয়ালে লুকায় রাখালগান,
আর কীভাবে তার মেয়ে চোখের তারায়
রাত জাগে আলোর অপেক্ষায়।
আমি হেঁটেছি হিমালয়ের পায়ের নিচে,
পেয়েছি এক ঋষির নীরবতা,
যিনি বলে গেছেন—
"সব শব্দের আগে আছে নীরবতা,
আর নীরবতারও আছে একটি দুঃখভরা উচ্চারণ।"
আমি হেঁটেছি রণভূমিতে—
যেখানে কবিতা নয়, কাঁদে কেবল শিশুরা,
যেখানে খেলনা হয়ে যায় বিস্ফোরক,
আর ঘুমিয়ে থাকা মা হারিয়ে যায় ধ্বংসস্তূপের ভেতরে।
আমি এক পলাতক প্রেমিক,
যে চিঠি লেখে অথচ পাঠায় না,
যার প্রেমিকা শুধু স্বপ্নে আসে—
কখনো জল হয়ে, কখনো আগুন হয়ে।
আমার কলমে আছে পাহাড়ের ঢেউ,
মরুভূমির রক্তাক্ত সূর্য,
আর মহাকাব্যের মতো দীর্ঘ নৈঃশব্দ্য,
যার শেষে কেউ নেই—
শুধু আমি, তুমি, আর অনন্ত শূন্যতা।
একদিন আমি থেমে যাব—
ঠিক যেন গোধূলির নরম রঙ ফুরিয়ে যাওয়া,
কিন্তু আমার কবিতা থেকে যাবে,
তোমার চোখে, তোমার নিশ্বাসে,
তোমার কোনও অনাহূত একাকী বিকেলে।
আর তখন তুমি বলবে—
"সে কবি ছিল না কেবল লেখক,
সে ছিল এক সমুদ্র,
যার ঢেউ ছিল শব্দ,
আর নীরবতা—এক বিস্মৃত গান।"