গল্প: “চিঠিওয়ালা মানুষ”
১
নাম তার আব্দুল কাইয়ুম, বয়স প্রায় সত্তর।
তবে তার চেহারায় বয়সের ক্লান্তি নেই,
থাকেন পুরান ঢাকার একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে,
আর প্রতিদিন সকালে চলে যান পোস্ট অফিসে—চিঠি দিতে।
কিন্তু আজকের যুগে কে আর চিঠি লেখে?
ইমেল, মেসেঞ্জার, ভিডিও কল—
সব কিছু ছুঁয়ে গেলেও,
এই বৃদ্ধ মানুষটা যেন আটকে আছে এক কাগজে মোড়ানো আবেগে।
২
কিন্তু যেটা সবাই জানে না, সেটা হলো—
এই চিঠিগুলোর কোনো প্রাপক নেই।
তিনি লেখেন, কিন্তু কখনো কোনো ঠিকানায় পৌঁছায় না সেগুলো।
কখনো লেখা হয় তার ফেলে আসা স্ত্রীর নামে,
কখনো মৃত বন্ধুর নামে,
কখনো এমন এক ছেলের নামে,
যে জন্মায়নি কখনোই।
চিঠির মধ্যে থাকে—
অভিমান, স্মৃতি, অনুতাপ, না বলা কথা।
৩
একদিন ডাকঘরের এক নতুন কেরানি, নাম আরিফ, কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল,
“চাচা, আপনি কাকে চিঠি পাঠান এত বছর ধরে?”
কাইয়ুম হেসে বললেন,
“যাদের কাছে পৌঁছানো যায় না, তাদের জন্যই তো সবচেয়ে দরকার চিঠি।”
আরিফ চুপ করে গেল।
সেদিন থেকেই সে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে লাগল কাইয়ুমকে।
কী লিখে, কার কাছে পাঠায়, কেন পাঠায়—
কিন্তু সব কিছুই যেন কুয়াশার মতো অস্পষ্ট।
৪
একদিন হঠাৎ কাইয়ুম অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
হাসপাতালে ভর্তির সময় তার হাতব্যাগ থেকে বের হলো একটা পুরনো খাতা—
যেখানে লেখা ছিল শত শত চিঠির খসড়া।
সবার একটাই শেষ লাইন:
> “যদি কোনোদিন আমার লেখা তোমার হৃদয়ে পড়ে, জানবে—আমি এখনো ভালোবাসি।”
৫
কাইয়ুম মারা যান পরদিন ভোরে।
তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিল আরিফ, ডাকঘরের কর্মীরা,
আর কেবল একটা ছোট মেয়ে, যার নাম রুশদি।
সে জানায়—তার মা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে,
কিন্তু তার মা সবসময় বলতেন,
"এক বৃদ্ধ চিঠি লেখেন আমার নামে, আর তাতেই আমি বেঁচে থাকি।"
রুশদি বলে,
“আমি এখনো চিঠি পাই না, কিন্তু আমি জানি—তিনি আমাকে ভালোবাসতেন।”
---
শেষ চিঠি
শেষ চিঠিটা আরিফ নিজের কাছে রেখে দেয়।
সেখানে লেখা ছিল:
> “আমাদের জীবনে অনেক মানুষ থাকে যারা কখনো কোনো উত্তর দেয় না,
তবু আমরা লিখি, ভাবি, ভালোবাসি—
কারণ জীবনের চেয়ে বড় কোনো ঠিকানা নেই।”---
গল্প: “আয়নার ভেতর রুমানা”
১
রুমানা থাকেন উত্তরার এক ফ্ল্যাটে, একা।
তিনি একজন চিত্রশিল্পী।
তার ছবি অদ্ভুত—প্রতিটি পোর্ট্রেটের চোখ যেন তাকিয়ে থাকে দর্শকের ভেতর দিয়ে।
তার ক্যানভাসে আলো-ছায়ার খেলা নয়,
বরং সময়, স্মৃতি আর শূন্যতার ছাপ ফুটে ওঠে।
কিন্তু গত এক মাস ধরে রুমানার জীবনে অদ্ভুত কিছু ঘটছে।
তার ঘরের আয়নাটা মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে—
একটা ছায়া যেন ওর পেছন থেকে তাকিয়ে থাকে।
২
প্রথমে সে ভেবেছিল ভ্রম, ক্লান্তি।
কিন্তু এরপর শুরু হলো ক্যানভাসে নিজের মুখ আঁকা—
যা সে নিজে কখনো আঁকেনি।
সে ঘুম থেকে উঠে দেখল, তার স্টুডিওর দেয়ালে এক বিশাল চিত্র,
যেখানে সে নিজে বসে আছে আয়নার সামনে,
আর আয়নায় দেখা যাচ্ছে তার এক অন্যমুখ—
একটু বয়স্ক, একটু ক্লান্ত, কিন্তু ভয়াবহ পরিচিত।
রুমানা সেই ছবি আঁকেনি।
কেউ এ বাড়িতে ঢোকেনি।
তবে চিত্রটা আছে—এবং নিখুঁত।
৩
ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, আয়নার ভেতরের সে
এক বিকল্প "রুমানা",
যে বেছে নিয়েছিল ভিন্ন জীবন—
যেখানে সে চিত্রশিল্পী হয়নি, বরং হয়তো শিক্ষকতা করেছে, বিয়ে করেছে, সন্তান আছে…
আয়নার রুমানা মাঝে মাঝে হাসে।
আস্তে আস্তে তার চোখ রুমানাকে টেনে নেয়।
এক রাতে সে টের পায়, আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার ছায়া পড়ে না।
৪
একদিন, একটা ডাক আসে—রাত তিনটায়।
ঘরের সব আলো নিভে যায়।
শুধু আয়না উজ্জ্বল।
রুমানা দাঁড়ায় আয়নার সামনে,
আর দেখে—ভেতরের রুমানা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
সে বলে, “এইপারে বেঁচে থাকার মতো কিছু নেই।
তুমি চিত্র আঁকো, আমি জীবন।
চলো, বদল করি।”
এক মুহূর্ত, আর তারপর… ঘরটা খালি।
৫
পরদিন সকালবেলা, পরিচারিকা এসে দেখে—ঘর যেমন তেমনই আছে,
কিন্তু আয়নায় এখন যে মুখ দেখা যাচ্ছে, সেটা ঠিক আগের রুমানার নয়।
আর দেয়ালের নতুন ছবিটা দেখে সে ভয় পায়—
একটা আয়না, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটো রুমানা—
একজন হাসছে, আরেকজন চেয়ে আছে স্তব্ধ চোখে।
---
শেষ।