ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ছেড়েছেন রাজপ্রাসাদ! আল্লাহর নীতি প্রতিষ্ঠায় নিজের ছেলেকেও এক বিন্দু ছাড় দেন তিঁনি। ছেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে করেছেন তাকে পরাহত।
পুরোটা জীবন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় ত্যাগ করেছেন যিনি, তিঁনি হলেন সিরিয়ার দামেস্কের রাজকন্যা, প্রভাবশালী শাসকের স্ত্রী ও মা জুমুররুদ খাতুন।
ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী এই নারীর জন্ম আধুনিক সিরিয়ার দামেস্কে। তাঁর পিতা ছিলেন সাফওয়াতুল মুলুক জাওয়ালি। যিনি দামেস্কের সেলজুক শাসক ছিলেন। তাঁর ভাই আবু নাসের শামসুল মুলুক দুকাকও পরবর্তী সময়ে শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে জুমুররুদ খাতুন একজন নেককার ও আল্লাহভীরু নারী ছিলেন। জীবদ্দশায় তিঁনি উস্তাদ আবু মুহাম্মদ তাউস ও আবু বকর কুরতুবি (রহ.)-এর কাছে কোরআন পাঠ করেন এবং নসর বিন ইবরাহিম মাকদিসি (রহ.)-এর কাছে হাদিস শ্রবণ করেন। জুমুররুদ খাতুন অধিক পরিমাণে নামাজ-রোজা ও দান-সদকা করতেন।
সেলজুক শাসনের সময়কালে এবং পূর্বেও অন্যায়ভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুরুষদের খোজা করা হতো। এই প্রথা তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু জুমুররুদ খাতুন এই প্রথাকে বৈধ মনে করতেন না। তাই, রাজপ্রাসাদের কোনো খোজার সঙ্গে তিনি নির্জন হতেন না। এই নিয়ে তিঁনি প্রতিবাদও করেছেন।
তিনি প্রথমে বুরি বিন তুগতেকিনকে বিয়ে করেন। ১১৩২ খ্রিস্টাব্দে, জুমুররুদ খাতুনের ছেলে শামসুল মুলক ইসমাইল দামেস্কের শাসক হন। কিন্তু তিনি ন্যায়পরায়ণ না হওয়ায় তিঁনি তাকে পছন্দ করতেন না।
দিনে দিনে জনগণের প্রতি ইসমাইলের অ*ত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। একসময় ইসমাইল ইমামুদ্দিন জাংকিকে দামেস্কের ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানান। বিষয়টি জুমুররুদ খাতুনের অবগত হলে, তিঁনি মামলুক সেনাদের সহযোগিতায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বাহিনী ইসমাইলকে হত্যা করে। বড় ছেলে নিহত হওয়ার পর দ্বিতীয় ছেলে শিহাবুদ্দিন মাহমুদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় দামেস্কের স্বাধীনতা রক্ষা ও ছেলের রাজত্ব সুসংহত করতে তিঁনি ক্ষমতার অংশীদার হন এবং মা-ছেলে উভয়ের পক্ষে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন।
মুসলিম ইতিহাসে ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে কোনো নারীর পক্ষে এমন শপথগ্রহণের ঘটনা খুবই বিরল। খলিফা তাঁকে বরখাস্ত না করে, কেবল ছেলের নিয়োগকে অনুমোদন দেন।
১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে, ইমামুদ্দিন জাংকি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার আগ পর্যন্ত জুমুররুদ খাতুন পরোক্ষভাবে দামেস্ক শাসন করেন।
ছেলের মৃত্যুর পর আরও এক বড় বলিদান দেন, জুমুররুদ খাতুন। নিজ দেশের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আশায় তিঁনি বিয়ে করেন ইমামুদ্দিন জাংকিকে।
বিয়ের পর তিঁনি আলেপ্পো শহরে চলে যান। বিয়ের কিছুদিন যেতেই ইমামুদ্দিন জাংকির পারিবারিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণের দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতা তাঁর চোখে পড়ে। সেই সাথে জনসাধারণের প্রতি অবিচার তিঁনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন নি।
প্রতিবাদসরূপ তিঁনি ইমামুদ্দিন জাংকির সংসার ত্যাগ করেন। তিঁনি চাইলে এইসব দেখেও কিছু না মনে করে ইমামুদ্দিনের প্রাসাদে আয়েশি জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেন নি। একই সময়ে, ১১৩৯ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর ছোট ছেলে নিহত হন। যার ফলে, দামেস্কে তাঁর পরিবারও ক্ষমতাচ্যুত হয়।
এসব নানা কারণে, তিঁনি হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে মক্কায় যান এবং সেখানে এক বছর অবস্থান করেন। এরপর মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। শেষ বয়সে তিঁনি নিঃস্ব হয়ে যান।
অথচ একসময় তিঁনিই বিশাল অর্থ দিয়ে দামেস্কের বিখ্যাত খাতুন মসজিদ নির্মাণ করেন। সেই সাথে মসজিদের আঙিনায় মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসা-মসজিদ পরিচালনায় যেন সমস্যা না হয়, সেই জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন।
তবে, নি:স্ব হলেও কখনও অন্যের কাছে হাত পাতেন নি তিঁনি। জীবিকার জন্যে গম ও বার্লি চালনার কাজ করতেন। এতে যে সামান্য অর্থ পেতেন তা দিয়েই কষ্টে জীবন যাপন করতেন। এবং বেশির ভাগ সময় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন তিঁনি।
৫৫৭ হিজরিতে বীরাঙ্গনা এই নারী ইন্তেকাল করেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর এই আত্নদানের স্বীকৃতি মহান রাব্বুল আলামীন নিশ্চয় তাঁকে দিবেন।