#। তোমার মুখ চোখ শুকনো লাগছে তো, তাই।"
"মাত্র ঘুমুতে নিচ্ছিলাম তো তাই হয়তো এমনটা লাগছে।"
"তোমার ঘরদোরর অবস্থা এমন কেন? এতটা এলোমেলো যে!"
তুহিন নরম হেসে উত্তরে বলল, "আমার ঘর গুছিয়ে রাখার মানুষ আজ অন্য কারো ঘর গুছানোর দায়িত্ব নিয়েছে তো সেজন্য।"
তুহিনের কথায় মোটেও ভড়কালো না নিরু। বরং বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, "তোমার ঘর গুছানোর জন্যও কেউ না কেউ ঠিক তৈরি আছে, তুহিন। চিন্তা করো না।"
"আর গুছানোর দরকার নেই, নিরু। অগোছালোতেই আজকাল আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।"
"তাই বললে হয় নাকি, তুহিন? এ জীবনকে সবসময় সুযোগ দিতে হয়। ঠিক ততদিন অব্দি সুযোগ দিতে হয় যতদিন অব্দি না জীবন সঠিক দিশে খুঁজে পায়।"
তুহিনের বোধহয় এই ব্যাপারে কথা বলার আর আগ্রহ জাগলো না। তাই কথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেলো।
"দাঁড়াও তোমাকে তো চা দিতেই বলা হলো না। মাকে বলে আসি তোমার জন্য চা বসাতে।"
"না, না, তুহিন, চা খাবো না।"
"কিন্তু তোমার তো চা পছন্দ ছিলো!"
"হ্যাঁ তুহিন, ছিলো। সেটা অতীত। এখন আর খাচ্ছি না।"
"ওহ্, সব পছন্দেরই পথ বদলে ফেলেছো?" প্রশ্ন করেই হাসলো তুহিন। সেই হাসিটা জমে উঠলো ঠোঁটের এক কোণে। চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়লো না সেই হাসি।
"সবার সব পছন্দ এক রকম থাকে না, তুহিন। পছন্দ বদলায়, প্রায়োরিটি বদলায়। এতে খারাপ কিছু নেই। কথায় আছে— মানুষের মন আর আকাশের রঙ এক। দু’টোই ক্ষণে ক্ষণে বদলায়।"
"যদি তোমার মনটা না বদলাতো কতই না ভালো হতো!" কথাটি খুব ধীরেই বলল তুহিন। তবুও নিরুর কান অব্দি ঠিক পৌঁছালো। কিন্তু নিরু এমন ভাব করলো যেন সে কথাটি শুনেইনি।
নিরু এবার নড়েচড়ে দাঁড়ালো। বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
"আমার তোমার সাথে দরকারী কথা ছিলো, তুহিন।"
"কী কথা?" তুহিনের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি।
নিরু কিছুটা সময় নিলো। ভেতর ভেতর হয়তো গুছিয়ে নিলো কথাগুলো। এরপর ফুঁস করে শ্বাস ফেলে তুহিনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"দেখো তুহিন, আমি বিশ্বাস করি যে, এ জীবন কারো জন্য থেমে যাওয়ার নয়। এই জীবন গতিশীল। সময় পরিবর্তনশীল। আজ যা আমার, কাল তা অন্যকারো। এটাই নিয়ম। কিন্তু তুমি যদি সেই শোকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দাও, জীবনের সকল আনন্দ মাটি করে পথ ধরো বিষাদের তাহলে তা অত্যন্ত কাপুরুষের মতো কাজ হবে। কারো জন্যই জীবন থামিয়ে দিতে নেই। এই যে দেখো, আমি ঠিক যেই মুহূর্তে অনুভব করেছিলাম তোমার ভেতর নিজের অস্তিত্ব কমে আসছে ঠিক সেই মুহূর্তে আমি পথ বদলে নিলাম। আমার গতিশীল জীবনকে গতিশীল রাখলাম। কারণ এ জীবন কারো জন্য থামিয়ে দেওয়ার নয়। তোমার উচিত এগিয়ে যাওয়া। নাহয় আজ থেকে পাঁচ বছর পর গিয়ে তোমার আফসোস হবে। মনে হবে, ইশ্ কেন যে তখন জীবনটাকে থামিয়ে দিয়ে ছিলাম! আমি হয়তো প্রেমিকা হিসেবে তোমার জীবনে চিরস্থায়ী হইনি কিন্তু আমি বন্ধু হিসেবে সবসময় তোমার পাশে থাকবো। আর আমি বন্ধু হয়েই চাইবো তুমি এগিয়ে যাও। তুহিনের এগিয়ে যাওয়ার পথে নিরুপমার স্মৃতি যেন বাঁধা নাহয়।"
"তুমি আমাকে বুঝাতেই এসেছো তাই না? নিজে এগিয়ে গিয়েছো বলে আমাকেও এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে এসেছো?"
"সত্যি বলতে তুহিন, আমাকে যেদিন বাবা বললেন আমাদের হাসবেন্ডের সাথে দেখা করার কথা, আমি তোমার পাওয়া কষ্ট গুলোর জন্য মান করেই দেখা করতে গেলাম। দেখা করে বুঝলাম ও না গুছিয়ে ভালোবাসতে জানে না তোমার মতন। তবে খুব যত্ন করতে জানে। আর যে আমাকে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই এতটা যত্ন করেছে সে আমাকে পেলে কতটা যত্ন করবে সেটা দেখার লোভ আমি ছাড়তে পারলাম না। এবং আমি মন খুলে বলতে পারি আমি ভালো আছি। হ্যাঁ তোমাকে এত সহজে ভুলে হয়তো যেতে পারবো না। বছরের পর বছর লাগিয়ে যে মায়ার জন্ম সেই মায়া কাটাতেও যে বছর লাগবে। কিন্তু মনের এক পাশটাতে আমার স্বামী মানুষটা যত্ন করেই জায়গা করে নিয়েছে। খুব চুপটি করে সে আমার মনের গভীরে চলে গিয়েছে। তাই আমি চাই তুমিও মুভ অন করো, তুহিন। আমি তোমার সুখী জীবন দেখতে চাই।"
"আমাকে ক্ষমা করো, নিরু। আমি ভালোবেসে ছিলাম কিন্তু তোমার মতন এত ভালো হতে পারিনি কখনো। সত্যিই আমি তোমাকে ডিজার্ভ করি না। এজন্য ভাগ্য আমাদের আলাদা করেছে। তুমি সুখী হও। আমি মন থেকে চাই, তুমি সুখী হও।"
নিরু হাসলো। তুহিনের টেবিলে একটি লাল গোলাপ রাখলো নীরবে। সাথে ছোটো একটি চিরকুট। এরপর প্রস্থান নিলো বিনা বাক্যে। যেমন করে তার বিচ্ছেদ ছিলো চির নির্বাক তেমন করেই।
নিরু বেরিয়ে যেতেই তুহিন সেই চিরকুটটা তুলে নিলো। খুলতেই নিরুর লিখা লাইনগুলো ভেসে উঠলো,
"আমি আর আমার হাসবেন্ড টেকনাফ চলে যাচ্ছি। আমি এক বার বলেছিলাম টেকনাফ আমার পছন্দ। পাগলটা জানো অফিসে ট্রান্সফারের আবেদন করে ফেলেছিলো আমাকে না জানিয়ে। পরশুদিন হুট করে বলছে ওর টেকনাফ বদলি হয়েছে। আমি প্রচন্ড অবাক হতেই বলল— আমি টেকনাফ ভালোবাসি তাই ও সেখানেই আমাকে রাখবে। এমন পাগলও হয় বলো? তাই আজ চলে যাচ্ছি। শেষবার দেখা করে গেলাম। তুমি খয়েরী শাড়িতে দেখতে চেয়েছিলে আমাকে। কথা ছিলো আমাদের বিয়ের পর আমি শাড়িটা পরে দেখাবো। কিন্তু সেটা তো আর হলো না তাই আজ তোমার ইচ্ছে পূরণ করে গেলাম। মনে আছে তুহিন, একদিন গোলাপ কিনে দিতে বলায় তুমি বিরক্ত হয়েছিলে? আজ আমাদের বিচ্ছেদের শেষবেলায় আমি স্মৃতি হিসেবে গোলাপ দিয়ে গেলাম। ভালো থেকো, তুহিন। তুমি ভালো আছো জানলে আমার জীবনে সুখ পরিপূর্ণ হবে।"
ব্যস্ চিরকুটটি শেষ। তুহিনের চোখের জল ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়লো চিরকুটটাতে। সে গোলাপটাকে মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো। তার ভালোবাসার শেষ সম্বল। তার বিচ্ছেদের স্মৃতি!
নিরুদের গাড়ি চলতে শুরু