# ছায়ায়। নীরব এবং অবশ তার আচরণ। শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো আবার সেই অস্বাভাবিক নীল রঙে রঞ্জিত। যেন রক্তের পরিবর্তে বিষ বয়ে চলেছে শিরা উপশিরাগুলো। অন্তরে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দাহ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে বটে। কিন্তু শান্তি! শান্তি নামক অনুভূতি তো এখনো অনেক দূরের নামহীন স্বপ্ন ই রয়ে গেছে। কৌশিকের মুখভরা যন্ত্রণা। চোখের গভীরে অশান্ত ও অনড় শূন্যতা।
বহু বছর আগে কৌশিক কোনো নতুন জীবন ফিরে পায়নি। শৈশব থেকেই তার জীবনে ছিল কেবল শাস্তি। কিন্তু সে হয়তো সয়ে নেওয়ার শক্তি নিয়েই জন্ম নিয়েছিল। তাই তো সবটাই সয়ে নিয়েছে কৌশিক।
প্রথমে পরিবারের চিরতরে হারানো, তারপর হুডো শহরের কিছু মানুষের অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রতিশোধের নেশায় ধীরে ধীরে সে মানুষ হতে ভুলে গিয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় শাস্তি ছিল অমৃতশক্তিকে নিজের শরীরে ধারণ করা। অজানা আতঙ্কে কৌশিকের চোখের কোণে জমে উঠল অশ্রু। কৌশিক উপরে তাকালো। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির পানিকণা তার অশ্রু ধুয়ে দিলো। কৌশিক মুচকি হাসলো। কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা তো রয়েই গেল।
সেদিন রাজকুমারীকে মেরে ফেলার পর কৌশিক বসেছিল রাজার সিংহাসনে। নিজের হুশ হারিয়ে ফেলেছিল বহু আগেই। শক্তির বোঝা ওর শরীরে এমন এক বিকট প্রভাব ফেলেছিল যে সে এক ভয়ঙ্কর লোভের দাসে পরিণত হয়েছিল। রাজার আসনে বসার পর আরহেনিয়ার রাজ্য ধীরে ধীরে শূন্য হতে শুরু করে।
কারণ কৌশিক তখনকার কায়েরীথ সেই রাজ্যটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ফেলছিল। যেই সাহস করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত কায়েরীথের এক আঙুলের ইশারাতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত।
এভাবেই কৌশিক! অথবা কায়েরীথ সময়কে সাক্ষী রেখে হিংস্র এবং ভয়ঙ্কর এক দানবের নামে পরিচিতি পেয়েছিল। অনেক বছর সে আরহেনিয়াতেই ছিল। সেই শক্তির বশে রাজ করছিলো। আরহেনিয়ায় মানুষ তখন কম ছিল বটে। তবু কৌশিক বেশ কয়েক বছর এক ধরনের মিথ্যা সুখের ভেতরেই কাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই অমিত শক্তির উপর আস্তে আস্তে নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় কৌশিক। আর তখনই ভেতর থেকে প্রচন্ডরূপে ভেঙে পড়ে সে। একদম যেরকমটি হয়েছিল আরহেনিয়ার পূর্বপুরুষের সাথে। কৌশিক বুঝতে পেরেছিলো সে যা কোনোদিন চায়নি তাই সে করে ফেলেছে এই কয়েক বছর। সে তো কখনো কারও উপর অত্যাচার করতে চায়নি। কখনো কোনো নির্দোষের প্রাণ কেড়ে নিতে চায়নি। তবুও করেছে। নিঃসংকোচে এবং নির্দয়ভাবে করে ফেলেছে সে। আর এই উপলব্ধিই তাকে ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলছে। নিজের উপর ধিক্কার জানিয়ে অসংখ্যবার ভেবেছে ল্যুমিস নদীর গভীরে গিয়ে সব শেষ করে দেবে। তবু বেঁচে থেকেছে। কিন্তু কেন? কৌশিক নিজেও জানত না স্পষ্ট করে। শুধু মনে হত কোনো এক অজানা উদ্দেশ্য এখনো তার জীবনের পাতায় লেখা রয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে দুনিয়ার বদলে যাওয়া দেখলো কৌশিক। নিজেকে সময়ের সাথে সাথে নতুন ভাবে তৈরি করলো এবং নিজের শক্তিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখলো। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রাণ নেওয়াও বাঞ্ছনীয় ছিল যা কৌশিকের কাছে অপছন্দনীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার লোভ সে সামলাতে পারেনি। আর সেই অজানা উদ্দেশ্য হয়তো রাজকুমারী আরিসার অপেক্ষা করাই ছিল। কিন্তু ভাগ্যের আশ্চর্য খেলায় এগিয়ে এলো অনন্যা। অনন্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে এখন নিজেকেই শেষ করে ফেলছে কৌশিক। কিন্তু এতে কোনো আফসোস নেই কৌশিকের। সবচেয়ে বড় আফসোস হচ্ছে মানুষের প্রাণও শেষ করে দিচ্ছে নিজের অজান্তেই। এ কি সত্যিই জীবন? নাকি এক অন্তহীন অভিশপ্ত যাপন!
কৌশিক উঠে দাঁড়ালো। আচমকা দূর থেকে অনন্যার কণ্ঠস্বর কানে ভেসে উঠল। কৌশিক চমকে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো। মনের অন্তরে অজানা আশঙ্কারা ঘুরঘুর করতে লাগলো। অনন্যার মনের আওয়াজ এখনো কানে বাজছে। কিন্তু এর অর্থ কি অনন্যার জ্ঞান ফিরেছে আর কৌশিককে খুঁজতেই বাড়ি ফিরছে সে? কৌশিক দেরি করলো না। নিজের সমন্বিত শক্তি ব্যবহার করে বাতাসের মাঝে মিলিয়ে গেলো সে।
******
নিক বাসায় এসেও বারবার ভেনোরাকে ফোন করে চলেছে। মাথা কাজ করছে না তার। এদিকে লারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কৌশিকের সেই ভয়ংকর রূপ দেখে ভেঙে পড়েছে সে। কৌশিক নাকি বাসায় এসেছিল। দানবের মতো সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। লারার কোনো ক্ষতি করেনি এটাই অনেক। তামং লারাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটছে। নোহারার সাথেও কথা হয়েছে নিকের। জানা গেছে অনন্যার নাকি জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু কৌশিকের কোনো খোঁজ নেই। দুই পাগলকে নিয়ে এতোদিন একসাথে ছিল নিকোলাই ভেস্পার। এখন তাদের একজন হুট করে হারিয়ে গেছে। তো আরেকজন কিছু একটা করে বেড়াচ্ছে যা সামলানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা সামলানোর জন্য প্রথম পাগলকেই দরকার। কিন্তু নেই! ভেনোরাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
বৃষ্টির মধ্যে ভিজে কোনো মতে বাড়িতে ফিরেছে অনন্যা। সাথে এসেছে নোহারাও। বাড়িতে প্রবেশ করেই অন্য কোথাও ধ্যান না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের রুমের দিকে চলে যায় অনন্যা। নিক কয়েকবার বলেছিল, কৌশিক বাড়িতে নেই। তবুও শুনলো না মেয়েটা। নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত অনন্যার শান্তি নেই। হয়তো বুকের ভেতরকার সেই দুঃসহ শূন্যতার জন্যই এমনটা করছে অনন্যা। নিকের ও খুব ভয় করছে। কৌশিকের কি হবে তাই নিয়েই তার সব চিন্তা।
নোহারা চিন্তিত মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে নিকের দিকে। চোখের পাতা দুটো নড়ছে না। স্থির হয়ে আছে সামনের মানুষটির দিকে। সামনের মানুষটির চিন্তা সেও খুব ভালোভাবে পড়তে পারছে। কিন্তু পরিস্থিতি যে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। নোহারা ভাবতে ভাবতেই নিক ওর দিকে তাকালো আর আচমকাই এগিয়ে এসে