পরীক্ষা যখন শেষ হলো তখন ঘড়ির কাটায় সময় ঠিক দুপুর একটা আটচল্লিশ। না খেয়ে বেরিয়ে ছিল বিধায় কিছুটা খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পেটে। মাথার উপর সূর্যটাও বড়োই উত্তপ্ত। শরীর পুড়িয়ে যেন আঙ্গার করে দেওয়ার উপক্রম। চিত্রা কলেজের গেইট পেরিয়ে ফুটপাতে দাঁড়াল। ব্যস্ত রাস্তার কোলাহল, পেটের খিদে, সূর্যের তেজে যেন নাজেহাল অবস্থা। রুক্ষ, শুকনো মুখটা রুগ্ন দেখাচ্ছে অনেক। চিত্রা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল। একা থাকা শিখে যাওয়া চিত্রার এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বোধ হলো তার পাশে বর্তমানে কেউ একটা থাকলে ভালো হতো। এই তীব্র কোলাহলে নিজেকে এত একা লাগছে! মানুষ যে বরাবরই সঙ্গীপ্রিয় প্রাণী। জীবনের কোথাও না কোথাও, কখনো না কখনো তারা সঙ্গীর আশা করে।
অবশেষে একটি খালি রিকশা পেতেই চিত্রা উঠে বসলো। আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। দাঁড়িয়ে থাকলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
শাহবাগের মোড়ে প্রচন্ড জ্যাম। রিকশা এগিয়ে যাওয়ার জায়গাটুকু নেই। গাড়ির অনবরত হর্ণ মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে যেন।
চিত্রা ডানে-বামে তাকাতে লাগল। বাহারি রঙের ফুলের দোকান দেখতে দেখতে এতক্ষণের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মনটা কখন যে শান্ত হয়ে গেলো সে টেরই পেলো না। ফুলের দোকান গুলোতে চোখ ঘুরাতে হুট করেই চিত্রার চোখ আটকে গেলো কিছু একটায়। চিত্রা এক ধ্যানে বা'দিকের অনেক দূরে থাকা চায়ের দোকানটার দিকে তাকাল। খুব পরিচিত একটা অবয়ব দেখে তার বুকের স্থির গতি থেমে গেল যেন। চিত্রা বহুটা সময় মূর্তির মতন তাকিয়ে থেকে কেবল অস্ফুটস্বরে বলল, ‘বাহার ভাই!’
জ্যাম ছুটে গেল তখনই। বিনা নোটিশে ছুটতে শুরু করল রিকশাটা। টং দোকানটা পেরিয়ে সামনে চলে গেলো। চিত্রার বড়ো শখ জাগল পেছন ফিরে আরেকটা বার ঘুরে দেখতে। কিন্তু মন সায় দিলো না। যদি স্বপ্ন হয় তাহলে যে মনটা ভেঙে যাবে!
রোদের তেজ কঠোর হলো। কী আশ্চর্য চোখটা এত জ্বালা করছে কেন? গরমে হয়তো। কিন্তু মনটা জ্বলছে কেন? এত আনচান লাগছে কেন তার?
-
কুঞ্জ বনে পুষ্প তখন নেতিয়ে গিয়েছে প্রায়। বসন্তের অভাবে গাছের পাতা শুকিয়ে লুটিয়েছে মৃত্তিকায়। শুকনো পাতায় পা ফেলে মড়মড় শব্দ তুলে সুখ তখন চলেই গিয়েছে বহুদূরে। সময় কেটে গিয়েছে বহুদিন। অষ্টাদশীর বয়স গুনতে গুনতে একুশের নারী হওয়ার গল্পটা উচ্ছ্বাসহীন পড়ে রইল বন্ধ ঘরের এক কোণায়। অলংকারহীন এই গল্প কেমন বিধবার মতন সাদা কাপড় জড়িয়ে সবটুকু রঙ কেড়ে নিয়েছে চঞ্চল তরুণীর আত্মা থেকে। সময়টা তখন কোনো এক মেঘ উড়ে যাওয়া শরৎ।
সওদাগর বাড়িতে হৈচৈ নেই। চেরিটার বয়স বাচ্চামো ছেড়ে দিয়েছে বহুকাল হলো। বাড়ির প্রাণ গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গিয়েছে অনেকদূর। বাড়িটারও যেন বয়স বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। হাসির মুক্ত না ঝরতে ঝরতে এটাও আজকাল প্রাণহীন হয়েছে।
চিত্রা বসে আছে তার বারান্দায়। ঘরের সাউন্ড সিস্টেমটায় গান বাজছে। একের পর এক বিরহ সুর করুণ স্বরে যেন গাইছেন চিত্রার যন্ত্রণা। স্বচ্ছ নীল আকাশে দলে দলে উড়ে বেড়াচ্ছে মেঘেদের দল। যেন চঞ্চল কিশোররা আকাশকে মাঠ বানিয়ে ফুটবল খেলছে। চিত্রার এক ধ্যান সেই মন্ত্রমুগ্ধকর গগণ বক্ষে। আনমনে কী ভেবে যেন পর পর ফেলল দীর্ঘশ্বাস। বুক ভারি লাগে তার আজকাল। চোখের নিচে পড়েছে কালো দাগ। বহুদিন না ঘুমানোর চিহ্নস্বরূপ। বাতাসে চুলগুলো অবাধ্য হচ্ছে ভীষণ। চিত্রা তাই অবহেলায় তা কানের পিঠে গুঁজে দিল। ঠিক তখনই হাতের গাঢ় লম্বাটে ক্ষতটা চোখে পড়ল। কী বিভৎস সেই ক্ষত! যে কেউ আৎকে উঠবে তা দেখে। সেই দুই-আড়াই বছরের আগের ক্ষত এখনও কতটা উজ্জ্বল হয়ে বসে আছে! বুকের ভেতর যেমন বিরহ ক্ষতরা আছে। চিত্রা হতাশ শ্বাস ফেলল। চোখের সামনে ভেসে ওঠল সেই বিদায় স্মৃতি। ঘর জুড়ে র ক্ত। সে উদাস নয়নে সামনের দোতালা বাড়িটার তালার দিকে এক বুক আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিল এই বুঝি বাড়িটার তালা খুলবে। আলো জ্বলে ওঠবে। গিটারের সুর ভেসে আসবে শৌখিনতায়। অথচ হলো না। চিত্রার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর....
চিত্রা আর ভাবে না সেই স্মৃতি। ভাবতে পারে না। যন্ত্রণা হয় ভীষণ। বুকের ভেতর হাপিত্যেশ করে মরে সেই যন্ত্রণা। দাফন দেওয়ার কেউ নেই। সে এই মৃত যন্ত্রণা নিয়েই পাড়ি দিচ্ছে জীবন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। চুল গুলো তখন অগোছালো ভাবে উড়ছে। ছোটো চুল তাই বাঁধাও যাচ্ছে না। কত শখের চুল গুলোও পাগলামির শিকার হয়। কোমড় ছেড়ে কাঁধে আসে। জীবনে কী করেনি সে? পরীক্ষা দিল না। বাঁচতে চাইল না। হাসল না আর। এভাবেই তো কেটে গেল দিনগুলো। রয়ে গেল অপেক্ষা। আবারও বেরিয়ে আসে হতাশার শ্বাস। পা রাখতে যায় ঘরের ভিতর। কিন্তু হুট করেই লোহার গেইট খোলার শব্দে তার পা থমকে যায়। বুক কেঁপে ওঠে। মতিভ্রম ভেবে ভুলও করে তবুও পেছন ফিরে না। যদি আবারও আশায় পানি পড়ে? সেই ভয়ে।
কিন্তু গেইট খোলার শব্দটা দ্বিগুণ হতেই তার বুকের কম্পন বাড়ে। মাত্রাতিরিক্ত বাড়ে। বহু কষ্টে, বুকে সাহস নিয়ে ঘুরে। বারান্দার কার্ণিশ ঘেঁষে নিচে তাকায়। পুরোনো আধ খসা বাড়িটার দিকে। অনাকাঙ্খিত দৃশ্যে তার চোখের দৃষ্টি থেমে যায়। হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক গতি, শব্দ যেন সেকেন্ডকেও হার মানায়। অদ্ভুদ চোখে সে চেয়ে থাকে নতুন এক পুরুষের দিকে। অস্ফুটস্বরে কেবল উচ্চারণ করে, 'বাহার ভাই...!'
ঘরের সাউন্ড সিস্টেমে তখন গান বাজছে,
"মোরা ভোরের বে
Read More
Md Habib Ullah
Slet kommentar
Er du sikker på, at du vil slette denne kommentar?