গল্প: “ছায়ার মতো”
নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি গ্রাম—নাম তার কনকপুর। চারদিকে ধানক্ষেত, মাঝে-মাঝে তালগাছ আর তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু কাঁচা রাস্তা। সেই গ্রামেই থাকত বারো বছরের একটি ছেলে—নামের আগে কেউ “ছোটো” না বললে যেন নামটা ঠিক জমত না—ছোটো রাজু।
ছোটো রাজু সবার প্রিয় ছিল, তবে তার একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। সে খুব বেশি কথা বলত না। একা একাই ঘুরে বেড়াত, নদীর ধারে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাঝে মাঝে দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকত নিরব দৃষ্টিতে। গ্রামের লোকজন বলত, “এই ছেলেটা স্বাভাবিক না। কিসের যেন ছায়া লেগে আছে।”
কিন্তু কেউ জানত না—রাজুর জীবনের ছায়াটা ছিল একেবারে আসল। ছায়ার মতোই একটি মেয়ে তার চারপাশে ঘুরে বেড়াত, চোখে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্ব স্পষ্ট।
মেয়েটির নাম ছিল তানিয়া।
তানিয়ার সঙ্গে রাজুর প্রথম দেখা হয়েছিল বছর দুয়েক আগে, যখন সে হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরছিল রাজু, হঠাৎ বিকেলের আলো ম্লান হয়ে এলো। পথ যেন অচেনা হয়ে গেল, চারপাশে ঘন কুয়াশা। ঠিক সেই সময়েই এক মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল—“ভয় পেও না, আমি আছি।”
তখন থেকেই তানিয়া তার ছায়া হয়ে রয়ে গেল। কেউ তাকে দেখতে পেত না, শুধু রাজুই পারত তার উপস্থিতি টের পেতে। কখনো সে নদীর ধারে রাজুর পাশে বসত, কখনো গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকত, আর রাতে—চাঁদের আলোয়—তার কণ্ঠস্বর কানে বাজত।
রাজু জানত, তানিয়া মানুষ নয়। সে অন্য জগতের। কিন্তু সে ছিল বন্ধুর মতো, সাহচর্য দিত। তানিয়া বলত, “আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম অনেক আগেই। তোমার মতোই আমি একদিন কনকপুরে থাকতাম। কিন্তু এক ঝড়ের রাতে আমি হারিয়ে যাই। আর কেউ আমাকে খুঁজে পায়নি।”
রাজুর চোখে জল এসে যেত, কিন্তু তানিয়া হেসে বলত, “দুঃখ কোরো না। এখন তুমি আছো। তুমিই আমার পথ।”
কিন্তু সবকিছুর একটা শেষ থাকে।
এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ করেই গ্রামে এক সাধু এসে পড়লেন। বললেন, “এই গ্রামে কিছু অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি আছে। কারও ছায়া তার জীবন ছাপিয়ে যাচ্ছে।”
গ্রামের লোকজন ভাবল রাজুর কথাই। সবাই মিলে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে ডাকল। রাজু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে জানত, এবার সময় এসেছে।
তানিয়া বলল, “তুমি চাইলে আমি চলে যাব, রাজু। কিন্তু জানবে, আমি কখনও তোমার কাছ থেকে দূরে যাইনি। শুধু তোমার ছায়া হয়ে থেকেছি।”
সাধু মন্ত্র পড়তে লাগলেন, ধূপের গন্ধে ভরে গেল চারদিক। হঠাৎই যেন হাওয়া থেমে গেল। আর রাজু শুধু বলল, “ওকে দোষ দিও না। ও আমার বন্ধু ছিল। শুধু একা ছিল।”
এক মুহূর্ত, আর তানিয়া আর নেই।
কিন্তু তার চলে যাওয়ার পরও রাজু মাঝে মাঝে অনুভব করে, কেউ তার পাশে হাঁটছে, হাওয়ায় এক মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে—“