একটি খেজুরের বিনিময়ে জান্নাত
ভূমিকা:
জান্নাতের জন্য মানুষের কী পরিমাণ ত্যাগ দরকার? কোটি টাকার দান? বিশাল মসজিদ নির্মাণ? হজ বা জিহাদ? সত্যিই কি এত বড় কিছু ছাড়া জান্নাত সম্ভব নয়? ইসলামী ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—আল্লাহ তায়ালা মানুষের ‘আমল’ নয়, বরং তার ‘নিয়ত’ দেখেন। তাই কখনো কখনো একটি খেজুর, এমনকি একটি দয়া ভরা দৃষ্টি বা কোমল শব্দও জান্নাতের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে।
এই গল্পটি এমনই এক দরিদ্র সাহাবীর, যিনি একটি খেজুরের বিনিময়ে অর্জন করে নিয়েছিলেন জান্নাতের স্থায়ী বাসস্থান।
মদিনার প্রান্তে এক গরিব সাহাবী
খালিদ নামের এক দরিদ্র সাহাবী ছিলেন মদিনার প্রান্তে বসবাসকারী। ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর, ঝুপড়ি টাইপের। সঙ্গী একমাত্র বৃদ্ধা মা এবং ছোট দুটি মেয়ে। প্রতিদিন তিনি খেজুরবাগানে দিনমজুরি করতেন, তাতে যা উপার্জন হতো, তা দিয়ে কোনো রকমে দু’বেলা খাবার জুটত। তবুও খালিদ ছিলেন চিরতৃপ্ত। মুখে সবসময় “আলহামদুলিল্লাহ” – এই বাক্য।
নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর কথা শুনেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অন্তর ছিল পরিপূর্ণ ঈমান ও তাকওয়ার আলোয় উদ্ভাসিত।
ফিতনার সূচনা
একদিন মসজিদে নববীতে বসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন:
"তোমাদের কেউ যদি একটি খেজুর দান করে, সেটিও আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন পর্বতসম সওয়াব হয়ে দাঁড়াবে, যদি তা হালাল ও খাঁটি নিয়তে হয়।”
(সহীহ বোখারি)
খালিদের মন ভরে গেল। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, “আজ আমি কিছু দান করবই।” কিন্তু সমস্যা হলো, তার কাছে কিছুই নেই।
সেদিন তিনি কাজ করলেন এক খেজুরবাগানে। মালিক তাঁকে মজুরি হিসেবে মাত্র তিনটি খেজুর দিলেন।
তিনি যখন ঘরে ফিরছিলেন, তাঁর মন তীব্রভাবে দ্বন্দ্বে পড়ল। তিনটি খেজুর—একটি মায়ের জন্য, দুটি মেয়েদের জন্য। যদি একটি খেজুর দান করেন, তবে কার মুখে তিনি খাবার দিতে পারবেন না?
আন্তরিক পরীক্ষার মুহূর্ত
বাড়ি ফিরে তিনি তিনটি খেজুর সামনে রাখলেন। মা ক্লান্ত, মেয়েরা ক্ষুধায় কাঁদছে। খালিদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
তিনি বললেন, “আম্মি, আমার দুটি মেয়ে, তোমাদের একজন একজন করে একটি করে খেজুর নাও। আমি আজকের উপার্জনের মধ্যে একটি খেজুর মসজিদে দান করব।”
মা বিস্মিত। “বাবা, তোমার নিজের তো কিছুই থাকছে না?”
খালিদ হাসলেন, “আমার নিজের প্রয়োজনের চাইতে বড় হলো জান্নাতের প্রয়োজন, আম্মি।”
তিনি একটি খেজুর নিয়ে ছুটে গেলেন মসজিদে। রাসূল ﷺ তখনো উপস্থিত। তিনি খেজুরটি নবীজির হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ, এটাই আমার উপার্জন। আমি এটা আল্লাহর রাস্তায় দান করতে চাই।”
নবীজির চোখে পানি
রাসূল ﷺ খালিদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আল্লাহ তোমার দান কবুল করুন, হে খালিদ। জান্নাত তোমার জন্য হাসছে।”
সহাবীগণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কেউ কেউ এত বড় ঘোষণা শুনে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা তো সোনা-রূপা দান করি, বড় বড় সম্পদ ব্যয় করি, আমাদের জন্য এমন ঘোষণা নেই?”
নবী ﷺ বললেন:
"তোমরা সম্পদের ভর দিয়ে দাও, আর খালিদ দিল অন্তরের গভীরতা দিয়ে। সে তার সবকিছু থেকে দিয়েছেঃ খেজুরের তিন ভাগের এক ভাগ, যা তার পরিবারের জীবন-মরণ নির্ভর করছিল। সে দিল আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ও ভালোবাসা থেকে।"
একটি খেজুর বনাম জান্নাতের বাগান
রাতে খালিদ একটি স্বপ্ন দেখলেন—অসাধারণ এক বাগান। সেখানে রয়েছে অসংখ্য খেজুরগাছ, প্রতিটি ঝুঁকে আছে, ফলছে সোনালী খেজুর, মাটি নয়—নরম মেশকের মতো, বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে। আর তার সামনে একজন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলছে:
“এই জান্নাত তোমার, সেই একটি খেজুরের বিনিময়ে। তুমি তোমার নিজের ক্ষুধা, তোমার পরিবারের চাহিদা উপেক্ষা করে আল্লাহর রাস্তায় দিয়েছ। আল্লাহ তা কবুল করেছেন।”
পরদিন সকালে
খালিদ সকালেই মসজিদে নববীতে গেলেন। রাসূল ﷺ তার দিকে তাকিয়ে বললেন:
“খালিদ, আমি তোমার স্বপ্নের কথা জানি। আমার রব আমাকে সে জান্নাত দেখিয়েছেন। তুমি ধন্য। তুমি সেই গরীব, যে জান্নাতের রাজা।”
খালিদের চোখ ঝলমল করে উঠল। কিন্তু তিনি আবার বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ, আমি তো শুধু একটি খেজুর দান করেছিলাম।”
নবীজী ﷺ মুচকি হেসে বললেন, “তোমার খেজুরটি হালাল উপার্জন, খাঁটি নিয়ত ও ত্যাগের সাথে দান হয়েছিল। সেই কারণেই তার ওজন পাহাড়সম হয়েছে।"
উপসংহার ও শিক্ষা
এই গল্প আমাদের শেখায়:
দান বড় নয়, নিয়ত বড় – আপনি কোটি টাকা দান করলেও যদি অহংকার থাকে, তা গোনাহ হতে পারে। আর একটি খেজুরও জান্নাতের পথ খুলে দিতে পারে যদি তা হয় আন্তরিকতার সাথে।
ত্যাগ ছাড়া প্রকৃত দান হয় না – খালিদ দান করেছিলেন নিজের প্রয়োজন উপেক্ষা করে। দান মানেই নিজের মনের লোভকে হারানো।
আল্লাহর বিচার অন্যরকম – মানুষ বাহ্যিকভাবে দেখে, কিন্তু আল্লাহ দেখেন অন্তর।
রাসূলুল্লাহ ﷺ দরিদ্রের মর্যাদা বোঝাতেন – সমাজে যারা অবহেলিত, তারাই ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে মূল্যবান হতে পারেন।
একটি প্রশ্ন আমাদের জন্য
আমরা কি কোনো দিন এমন একটি খেজুর দান করতে পেরেছি, যা আমাদের জান্নাতের অধিকারী করে তুলতে পারে?
আজ যখন আমরা আমাদের প্লেট থেকে খাবার ফেলে দেই, যখন দান করতে গিয়ে "কিন্তু" বলে পিছিয়ে যাই—তখন খালিদের সেই খেজুরের কথা মনে করা উচিত।