ধৈর্যের পুরস্কার – গরীব সাহাবীর গল্প
ভূমিকা
ইসলামে ধৈর্য একটি বিশাল গুণ। ধৈর্যের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে, আর সেই ধৈর্যই আখিরাতে জান্নাতের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। আজকের গল্পটি এমনই এক গরীব সাহাবীর, যিনি জীবনভর কষ্ট সহ্য করেও মুখে একটিবারও অভিযোগ আনেননি। বরং তাঁর অন্তরে ছিল দৃঢ় বিশ্বাস: “আমার রব যা দেন, তা-ই ভালো।”
মদিনার এক নিরবে থাকা সাহাবী
নাম ছিল সালিম। মানুষ তাঁকে ডাকত “আস-সাবির” – অর্থাৎ ধৈর্যশীল। তিনি ছিলেন এতটাই দরিদ্র যে মদিনার বাজারে অনেকেই তাকে চিনত না। এমনকি কখনো কখনো কেউ মনে করত তিনি মদিনার বাহির থেকে আসা কোনো পথিক। তার গায়ে ছিল মেরামত করা পুরনো কাপড়, হাতে মোটা বাঁশের লাঠি, পায়ে ধূলিমাখা স্যান্ডেল।
কিন্তু যেটা তার ছিল, তা হলো চিরস্থায়ী হাসিমুখ ও ধৈর্যভরা হৃদয়।
সাহাবীগণের চোখে সালিম
একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ মসজিদে নববীতে সাহাবীদের বললেন,
“আজ এমন একজন মানুষ আসবে, যে জান্নাতি।”
সাহাবীগণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেন। কে হবে সেই সৌভাগ্যবান? ধনবান সাহাবী? কুরআনের হাফেজ? জিহাদের বীর? কিন্তু তখন দরজায় দেখা গেল সালিমকে—মাটিতে ধুলো লেগে থাকা কাপড়, হাতে একটি জঞ্জাল মোছার ঝাঁটা।
সকলেই হতবাক!
সাধারণ চেহারা, অসাধারণ মর্যাদা
তিনদিন পর আবার রাসূল ﷺ একই কথা বললেন:
“এখন যে আসছে, সে জান্নাতি।”
এবং আবারও সালিম!
শেষদিনও এমনই ঘটল।
আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) পরে সালিমের বাড়িতে রাত কাটালেন, যেন বুঝতে পারেন তার বিশেষ আমল কী। তিনি লক্ষ্য করলেন:
সালিম রাতের কিছু অংশে নামাজ পড়েন।
না আছে বাড়তি রোযা, না বিশেষ কোনো লম্বা দোআ।
সালিম সহজ-সরল, শান্ত।
অবশেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, তোমার এমন কী আমল আছে, যার কারণে রাসূল ﷺ তোমাকে জান্নাতি বললেন?”
সালিমের জবাব
সালিম মৃদু হেসে বললেন,
“আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন আমার অন্তর পরিষ্কার করে দেই। কারো প্রতি হিংসা, কষ্ট, হেয় ভাবনা রাখি না। কেউ আমার সঙ্গে অন্যায় করলেও, আমি ক্ষমা করে দেই।”
এই কথাই ছিল তার ‘আলাদা আমল’। ধৈর্য, ক্ষমা ও পরিশুদ্ধ অন্তরই তাকে জান্নাতের অগ্রাধিকার দিয়েছে।
সালিমের কঠিন জীবন
তাঁর জীবনের কষ্ট যেন ছিল সীমাহীন—
একমাত্র ছেলে হাবিব, ছোটবেলায় অসুস্থ হয়ে মারা যায়।
স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার, কিন্তু অল্পদিনেই ইন্তেকাল করেন।
দিন কাটত কখনো দিনমজুরিতে, কখনো মসজিদে ঝাড়ু দিয়ে।
তবুও সালিমের মুখে কোনোদিন কেউ অভিযোগ শুনেনি। তিনি বলতেন,
“যে সবর করে, আল্লাহ তার সাথেই থাকেন।”
রাসূল ﷺ এর স্নেহ
একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে এক মজলিসে সামনে ডাকলেন এবং বললেন,
“সালিম, আমি দেখেছি জান্নাতে তুমিই প্রথম আমার পাশে দাঁড়িয়েছো।”
সালিম কেঁদে ফেললেন। বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি তো গরীব, নিঃস্ব। আপনার সাহচর্য আমি কীভাবে পেলাম?”
নবীজী ﷺ বললেন:
“তুমি সবর করেছো, আল্লাহর ওপর ভরসা করেছো, কারো কাছ থেকে কিছু চাওনি। আল্লাহ তোমার সেই ধৈর্যকে ভালোবেসেছেন।”
মদিনায় দুর্ভিক্ষ
এক বছর মদিনায় ভয়াবহ খরা দেখা দিল। অনেকেই খাদ্যের অভাবে চুরি করতে লাগল। অথচ সালিম প্রতিদিন দুই খেজুর আর এক গ্লাস পানিতে দিন কাটালেন। কেউ জানতে পেরে বললেন, “তুমি চাইলে তোমার জন্য ধনীদের কাছে সাহায্য চাইতে পারো।”
সালিম বললেন:
“আমি চাই না আমার প্রয়োজন মানুষের কাছে তুলে ধরি। যে ‘আর-রাযযাক’, তিনি জানেন কখন কী দেবেন।”
এমন শক্ত ঈমান আজ কজনের আছে?
পুরস্কারের মুহূর্ত
সালিম যখন ইন্তেকাল করলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজ হাতে তাঁর জানাজা পড়ালেন। চোখে পানি এনে বললেন:
“এই ব্যক্তিকে পৃথিবী চিনলো না, কিন্তু আসমান তাঁকে সোনার থালায় বরণ করে নিলো।”
তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে রাসূল ﷺ বললেন:
“হে সালিম! তুমি সেই গরীব, যাকে সবাই অবহেলা করেছে, কিন্তু আল্লাহ তাঁর ধৈর্যের কারণে জান্নাতের রাজা বানিয়েছেন।”
পাঠকের জন্য শিক্ষা
এই গল্প আমাদের কী শেখায়?
ধৈর্য কেবল কষ্ট সহ্য নয়, বরং অভিযোগহীন জীবনযাপন।
আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা কখনো ব্যর্থ হয় না।
আল্লাহ মানুষের অবস্থা নয়, অন্তর দেখেন।
দুনিয়ায় পরিচিত না হলেও আখিরাতে তোমার মর্যাদা অনন্য হতে পারে।
ক্ষমাশীল হৃদয় ও পরিশুদ্ধ নিয়ত জান্নাতের পথে পাথেয়।
আখিরাতই আসল পুরস্কার
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলদেরকে তাদের প্রতিফল পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই।”
(সূরা যুমার: ১০)
একটি বাস্তব প্রশ্ন
আজ আমরা কষ্ট পেলে কি আল্লাহকে স্মরণ করি?
নাকি অভিযোগ করি: “আল্লাহ কেন আমার সঙ্গে এমন করলেন?”
সালিমের মতো সাহাবীরা ছিলেন যারা কষ্টের মাঝেও বলতেন,
“আলহামদুলিল্লাহ ‘আলা কুল্লি হাল” – “সকল অবস্থায় প্রশংসা আল্লাহর।”
উপসংহার
এই গরীব সাহাবী হয়তো দুনিয়ায় কোনো পদ-মর্যাদা পাননি। তার না ছিল দামী পোশাক, না ছিল বড় ঘর বা বাগান। কিন্তু তার ছিল একখণ্ড পরিশুদ্ধ হৃদয়, যার প্রতিদান আল্লাহ নিজ হাতে দিলেন।
আমরা যদি অন্তরে পরিশুদ্ধি আনি, সবরে জীবন যাপন করি, মানুষের প্রতি হিংসা না রাখি—তবে হয়তো একদিন আমাদের নামও ঘোষণা হবে:
“এখন যে ব্যক্তি আসছে, সে জান্নাতি।”