পাখির বাসা ও মসজিদের ছাদে দয়া
ভূমিকা
মসজিদ—এক পবিত্র স্থান, যেখানে মানুষ সেজদা দিয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জানায়। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, যদি সেই মসজিদের ছাদে বাসা বাঁধে এক জোড়া পাখি, আর তার বাচ্চা—তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কী? দয়া শুধু মানুষের প্রতি নয়, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির প্রতিও।
এই গল্পে আমরা দেখব একজন ইমাম, একজন কাঠুরে, আর একটি ছোট পাখির বাচ্চা কীভাবে এক মহান শিক্ষা দিয়ে গেল।
ছোট্ট এক গ্রাম ও তার মসজিদ
বৃক্ষপল্লীতে ঘেরা ছোট এক গ্রাম—নাম ‘নূরনগর’। গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত স্থানটি ছিল কেন্দ্রস্থ মসজিদটি—সাদা দেয়ালে ঘেরা, টিনের ছাদে গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রাচীন মসজিদ।
ইমাম সাহেব, মাওলানা আব্দুল মতিন, ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও গ্রামের শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। তাঁর মুখে সবসময় থাকে “সাবর করো”, “মাফ করো”, “দয়া করো”—এই তিন বাক্য।
এক জোড়া অতিথি পাখি
রোজার এক গরম দিনে, ফজরের নামাজ শেষে ইমাম সাহেব ছাদের একপাশে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন কিছু খড়, শুকনো পাতা আর ছোট্ট ডাল দিয়ে একটা বাসা তৈরি হচ্ছে।
তাঁর চেহারায় হাসি ফুটে উঠল। বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর আরেকটি সৃষ্টি আমাদের মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে।”
পরদিন দেখা গেল, সেই বাসায় বসেছে এক জোড়া ‘বুলবুলি’ পাখি। পুরুষ পাখিটি ছাদের এক কোনায় বসে গান গাইছে, আর স্ত্রী পাখিটি ডিমে তা দিচ্ছে।
মসজিদ পরিষ্কারকারী ও দ্বিধা
একদিন মসজিদের পরিচ্ছন্নতা কর্মী কাশেম সাহেব ছাদে গিয়ে ফিরে এলেন কপালে ভাঁজ নিয়ে।
তিনি বললেন,
“হুজুর, ছাদের কোণায় পাখির বাসা হয়েছে। ওরা মলত্যাগ করে নোংরা করছে। আমি আজই ওটা ফেলে দেব।”
ইমাম সাহেব মৃদু হাসলেন। বললেন,
“কাশেম ভাই, এই মসজিদ তো শুধু মানুষের সেজদার জায়গা নয়, এটা আল্লাহর সব সৃষ্টির জন্য আশ্রয়। ওরা তো চুরি করেনি, বরং দয়া চেয়ে এসেছে।”
বাসা রক্ষা ও শিক্ষা
ইমাম সাহেব ঘোষণা করলেন,
“পাখির বাসা কেউ ছুঁবেন না। ওরা ডিম দিয়েছে। যতক্ষণ না ছানারা উড়ে যেতে পারে, ওদের নিরাপদ রাখতে হবে। যারা দয়া করে, আল্লাহ তাদের প্রতি আরও দয়া করেন।”
এই ঘোষণা গ্রামের শিশুদের কাছে ছিল এক আনন্দের বিষয়। তারা প্রতিদিন মসজিদের আশপাশে পাখির গানে মুগ্ধ হতো, কেউ কেউ খেজুরে ভেজানো পানি ছাদের এক পাশে রেখে আসত, যাতে পাখিরা গরমে পিপাসায় না মরে।
বিপদের আভাস
একদিন মসজিদে আসলেন এক নতুন ব্যক্তি—চোখে রাগ, হাতে দড়ি। নাম তার আকরাম। তিনি শহর থেকে এসে গ্রামে একটি জমি কিনেছেন। গ্রামের নিয়ম-কানুনে কিছুটা বিরক্ত।
তিনি বললেন,
“ইমাম সাহেব, মসজিদের ছাদ নোংরা! এটা একদম গ্রহণযোগ্য নয়। পাখি দিয়ে মসজিদ অপবিত্র হচ্ছে। এভাবে চললে দান বন্ধ করে দেব!”
এ কথা শুনে কিছু মানুষও দ্বিধায় পড়ে গেল। কিছু বলল, “হ্যাঁ, মসজিদ পরিষ্কার থাকা দরকার”, আবার কেউ বলল, “তাও তো জীব!”
ইমাম সাহেবের খুতবা
জুমার দিন ইমাম সাহেব খুতবায় বললেন:
“একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এক নারী একটি বিড়ালকে বন্দী করে রেখেছিল, সে না তাকে খেতে দিল, না ছেড়ে দিল, ফলে সেই নারীর দোজখ হয়েছে।”
(সহীহ বুখারী)
“আবার এক পতিতা নারী একটি কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে জান্নাতে প্রবেশ করেছে।”
তারপর তিনি বললেন:
“দেখো, যেখানে আল্লাহ একটি পশুর প্রতি দয়ার কারণে জান্নাত দিচ্ছেন, সেখানে আমরা কী করে তার সৃষ্টিকে কষ্ট দিয়ে নিজেদের জান্নাত হারাই?”
ঝড়ের রাত
এক রাতে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়, বৃষ্টি আর বজ্রপাত শুরু হলো। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে ছিল। মসজিদের পাশের পুরনো গাছগুলো একে একে উপড়ে পড়ল।
পরদিন ফজরের নামাজে ইমাম সাহেব দ্রুত ছাদে উঠে গেলেন—পাখির বাসা কি টিকে আছে?
হ্যাঁ! আল্লাহর রহমতে পাখির বাসা অটুট ছিল। কিন্তু এক ছানা মেঝেতে পড়ে গিয়েছে—ভেজা, কাঁপা, নির্জীব।
ছোট্ট ছানাটিকে কোলে তোলা
ইমাম সাহেব নিজ হাতে ভেজা ছানাটি তুললেন। তারপর নিজের কোটের পকেটে রেখে নামাজ পড়ালেন। নামাজ শেষে একটি উষ্ণ তোয়ালে ও কিছু খাবার দিয়ে পাখিটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন।
চারপাশে কিছু বাচ্চা শিশুও তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বলছিল,
“হুজুর, পাখিটা কি বাঁচবে?”
তিনি বললেন,
“জান্নাতে একদিন এরা সাক্ষী দেবে—কে তাদের রক্ষা করেছে, আর কে করেছে নির্দয়তা।”
আকরামের বদলে যাওয়া
ঘটনার পর আকরাম একদিন একা এসে ইমাম সাহেবের কাছে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন:
“হুজুর, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেন। আমি এতদিন শুধু বাইরের পবিত্রতাকে দেখেছি, ভেতরের দয়াকে না। আজ আমি বুঝলাম, মসজিদের আসল সৌন্দর্য তার ভেতরের হৃদয়।”
তিনি ঘোষণা দিলেন,
“আমি মসজিদের নতুন টিনের ছাদ দেব। আর যেন পাখিরা আরও নিরাপদে থাকতে পারে, এমন ব্যবস্থা করব।”
পাখির উড়ে যাওয়া ও হৃদয়ের দয়া
কয়েক সপ্তাহ পরে পাখির ছানারা উড়ে গেল। পুরো গ্রামে যেন আনন্দের ঢেউ। শিশুদের চোখে জল, যেন বিদায় নিচ্ছে এক আত্মীয়। ইমাম সাহেব বললেন:
“যারা আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালবাসে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। এই মসজিদ আজ শুধু নামাজের স্থান নয়, দয়ার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”
উপসংহার: আপনি কি দয়া দেখাচ্ছেন?
এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
পবিত্রতা কেবল বাহ্যিক নয়, দয়া ও মাফের মাঝেও পবিত্রতা থাকে।
আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া করা, তাঁর সন্তুষ্টির একটি মাধ্যম।
শুধু মানুষ নয়, পাখি, গাছ, প্রাণী—সবই আল্লাহর বান্দা।
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“তোমরা দয়া করো যাদের ওপর তোমরা কর্তৃত্ব করো, তাহলে আসমানের অধিপতি তোমাদের ওপর দয়া করবেন।”
(আবু দাউদ)