“সাজিদের সন্ধান”
একটি ছোট গ্রামে বাস করত এক যুবক, নাম তার সাজিদ। শান্ত স্বভাব, সদাচার, আর নামাজে কখনো গাফেল হত না সে। বাবা-মা তাকে ছোটবেলা থেকেই কুরআন শিক্ষা, ইসলামী আখলাক ও আল্লাহভীতি শিখিয়েছিলেন। সাজিদ বড় হলেও সেই শিক্ষা থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি।
গ্রামটি ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে, সেখানে কৃষিই ছিল মূল জীবিকা। সাজিদের বাবা ছিলেন একজন কৃষক। সাজিদও বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করত, কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে ছিল এক অন্য রকমের আকাঙ্ক্ষা — সে চেয়েছিল বড় আলেম হতে, ইসলাম সম্পর্কে জানতে এবং জানাতে।
স্বপ্নের পথে যাত্রা
একদিন সাজিদ তার বাবা-মায়ের কাছে এসে বলল, “আব্বা, আম্মা, আমি চাচ্ছি মাদ্রাসায় ভর্তি হতে। আমি চাই আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করতে।”
বাবা-মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারা গরিব মানুষ, ছেলেকে দূরের শহরে পাঠানোর খরচ জোগানো সহজ ছিল না। কিন্তু তারা জানতেন, এই ইচ্ছা আল্লাহর দিকে যাওয়ার পথ। চোখে জল এনে বাবা বললেন, “সাজিদ, আল্লাহর পথে চলার ইচ্ছা যদি থাকে, তবে আল্লাহই পথ খুলে দেবেন। যাও, আমরা দোয়া করব।”
সেই সপ্তাহেই সাজিদ শহরের এক বিখ্যাত মাদ্রাসায় ভর্তি হলো। শুরু হলো তার এক নতুন অধ্যায়।
পরীক্ষার শুরু
মাদ্রাসার জীবন সহজ ছিল না। পড়াশোনার চাপ, আত্মসংযম, আর ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল। তবে সাজিদের আত্মবিশ্বাস ছিল মজবুত — সে জানত, আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য ধৈর্য আর ইখলাস দরকার।
একদিন তার ক্লাসে একজন নতুন শিক্ষক এলেন — হাফেজ ইব্রাহিম সাহেব। অত্যন্ত বিদ্বান এবং নম্র একজন মানুষ। তিনি ছাত্রদের শুধু পড়াতেন না, বরং তাদের আত্মশুদ্ধির শিক্ষাও দিতেন।
তিনি একদিন বললেন, “ইলম কেবল মুখস্থ করলেই হয় না। ইলম এমন একটি আলো, যা হৃদয় আলোকিত করে। যারা জ্ঞানকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খোঁজে, তাদেরই এই আলো উপহার দেন আল্লাহ।”
এই কথা সাজিদের হৃদয়ে গেঁথে গেল। সে নিজেকে নিয়মিত আত্মসমালোচনা করত — “আমি কি কেবল নামের জন্য পড়ছি, না কি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য?”
একটি বড় সিদ্ধান্ত
মাদ্রাসার চতুর্থ বছরে, হঠাৎ সাজিদের বাবার মৃত্যু হয়। খবরে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। গ্রামের বাড়িতে ফিরে দেখে মা একা, মাঠ পড়ে আছে অনাবাদি, দেনা বাড়ছে। অনেকে বলে, “তুই শহরে পড়িস, তোর মা এখানে একা, এখন তুই কী করবি?”
সাজিদের হৃদয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। একদিকে মা ও সংসারের দায়িত্ব, অন্যদিকে ইলমের সাধনা। রাতে তাহাজ্জুদের নামাজে কান্নাকাটি করে আল্লাহর দরবারে বলে, “হে রব্ব, তুমি যে পথ আমাকে দেখিয়েছিলে, এখন আমি দ্বিধায় পড়েছি। তুমি পথ দেখাও।”
আল্লাহর রহমত
পরদিন সকালে গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব সাজিদকে ডেকে বললেন, “তোমার মাদ্রাসার শিক্ষক ইব্রাহিম সাহেব এসেছেন তোমার জন্য। দেখা কর।”
সাজিদ ছুটে যায়। ইব্রাহিম সাহেব বলেন, “তোমার খবর পেয়ে এসেছি। মাদ্রাসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে একটি বিশেষ বৃত্তি ও কিছু পার্ট-টাইম দায়িত্ব দেব — তুমি তোমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে, আর প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতে পারবে ঘরে। আমরা বিশ্বাস করি, তুমি ভবিষ্যতে অনেকের পথপ্রদর্শক হবে।”
সাজিদের চোখে জল চলে আসে। সে আল্লাহর কাছে সেজদায় পড়ে যায় — “হে আল্লাহ, তুমিই যথেষ্ট আমার জন্য!”
শেষ পরীক্ষা
সাজিদ আবার শহরে ফিরে যায়, পড়াশোনা শেষ করে আলেম হিসেবে বের হয়। এরপর তার জীবনের লক্ষ্য হয়, গ্রামে ফিরে নিজের মাদ্রাসা গড়ে তোলা।
গ্রামে ফিরে আসে সে। ছোট একটি কুটিরে শুরু করে “নূরের পথ মাদ্রাসা”। প্রথমে পাঁচজন ছাত্র। নিজের হাতে পড়ায়, রান্না করে, ঝাড়ু দেয় — কোনো লজ্জা করে না। সে জানত, রাসূল (সা.) নিজেও ঘরের কাজ করতেন, আর শিক্ষা ছড়াতে কষ্ট সহ্য করতেন।
বদলে যাওয়া এক গ্রাম
কয়েক বছর পর, সেই গ্রামে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। যেই গ্রাম আগে ফজরের আজানে ঘুমাত, এখন সেখানে ফজরের পর কুরআনের আওয়াজ শোনা যায়। যেই তরুণরা আগে অলস সময় কাটাত, তারা এখন দাওরায়ে হাদীস পড়ে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে কুরআন, ইসলামিক বই, ও ইলমের আলো।
গ্রামের মানুষ বলে, “সাজিদ শুধু আলেম না, সে আমাদের হৃদয়ের শিক্ষক।”
একবার সাজিদকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, “আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?”
তিনি উত্তর দিলেন, “আমি যখন একজন ছাত্রকে দেখি যিনি অন্যকে নামাজ শেখান, কুরআন পড়ান, আর ভালো মানুষ হন — তখন মনে হয়, আমি সফল। কারণ রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই, যে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায়।’”
গল্পের শিক্ষা
এই গল্প আমাদের শেখায়:
ইচ্ছা থাকলে আল্লাহ পথ খুলে দেন — সাজিদের ইলম অর্জনের ইচ্ছাকে আল্লাহ সহায়তা করেছেন।
ধৈর্য ও তাওয়াক্কুল — জীবন যখন কঠিন, তখনও আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখে চলা উচিত।
ইলম কেবল তথ্য নয়, আচরণের আলো — জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি।
পরিবর্তন শুরু হয় একজন থেকে — একটি গ্রামের ইসলামি জাগরণ একজন যুবকের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে।
shakhawat josim Shah
تبصرہ حذف کریں۔
کیا آپ واقعی اس تبصرہ کو حذف کرنا چاہتے ہیں؟