"চুপচাপ ভালোবাসা"
চুপচাপ ভালোবাসাও একরকম বৃষ্টি—ঝরে পড়ে শব্দহীন, কিন্তু ভেজায় গভীরভাবে।
নামিরা একজন গ্রন্থাগারিক। বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, নরম স্বভাবের, চুপচাপ জীবনযাপন করেন। ঢাকার এক সরকারি কলেজের গ্রন্থাগারে কাজ করেন তিনি। প্রতিদিন সকাল ন’টায় আসেন, বিকেল চারটায় বের হন। লাইব্রেরির নিরবতায় তাঁর স্বস্তি। শব্দহীনতা যেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
কিন্তু এই নীরবতার মধ্যেও কেউ একজন ছিল, যে তার দিকে প্রতিদিন চুপিচুপি তাকাত।
সায়ান। বাংলার অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। লাজুক, গম্ভীর, বই পড়ায় পাগল। লাইব্রেরির জানালার পাশে নির্দিষ্ট একটি চেয়ার তার প্রিয়। সেখানেই সে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা—বই পড়ে, চুপচাপ নামিরার দিকে তাকায়।
নামিরা কখনও মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু তিনি বুঝতেন। সায়ানের চোখে সেই ভাষা ছিল, যা শব্দ ছাড়াই কথা বলে।
একদিন, হঠাৎ করেই কলেজে এক ঘোষণায় জানানো হলো—নতুন ডিজিটাল লাইব্রেরি তৈরি হবে, পুরোনো গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যাবে।
নামিরা যেন ভেতর থেকে কেঁপে উঠলেন। এই ঘর, এই টেবিল, এই নীরব পাঠকরা—সবই ছিল তাঁর জীবনের অংশ। এখন সব বদলে যাবে?
সেই দিন বিকেলে, যখন সবাই চলে গিয়েছে, হালকা বৃষ্টি নামছিল বাইরের গাছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা। নামিরা শেষ বইগুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন।
হঠাৎ পেছন থেকে সায়ান বলে উঠল, “আপা, একটু কথা বলব?”
নামিরা ঘুরে তাকান, চোখে কৌতূহল।
সায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “এই ঘরটার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত, আপনি জানেন?”
নামিরা মৃদু হাসলেন, “জানি।”
“আর আপনি?” সায়ান ধীরে বলল, “আপনাকে দেখেই আমি সাহস পেয়েছিলাম আবার বইয়ের প্রেমে পড়তে। শহরের কোলাহল থেকে একটা আশ্রয় পেয়েছিলাম এখানে।”
নামিরা বললেন, “সবারই কিছু আশ্রয় থাকে। এটা হয়তো তোমার ছিল।”
সায়ান একটু এগিয়ে এল। তার হাতে একটা ছোট খাম।
“আপনার জন্য। বইয়ের মাঝে রেখেছিলাম, দিতে সাহস পাইনি। আজ বলেই ফেলি—আমি আপনাকে ভালোবাসি, চুপচাপ, প্রতিদিন।”
নামিরার চোখ ফেটে জল নামল না, কিন্তু বুকটা ভারী হয়ে উঠল। সে বলল না কিছুই, শুধু বলল, “তুমি বইয়ের মানুষ, অনুভব বোঝো। আমি অনুভব রাখতে ভালোবাসি, প্রকাশ নয়।”
সায়ান মাথা নিচু করল। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
সেই দিন থেকেই লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেল।
তিন বছর পর।
নতুন ডিজিটাল লাইব্রেরির উদ্বোধন চলছে। বড় বড় স্ক্রিন, ডিজিটাল আর্কাইভ, ছাপা বইয়ের গন্ধ নেই, শুধু কাচ আর প্রযুক্তি।
নামিরা এখনো আছেন, তবে তিনি এখন ‘ডিজিটাল রিসোর্স ম্যানেজার’। আগের মতো নীরবতা নেই, চারদিকে শুধু ক্লিকের শব্দ।
সেই দিন দুপুরে, একটি ছেলে লাইব্রেরিতে ঢুকল। চোখে চশমা, হাতে একটি পুরনো খাতা।
নামিরা তাকিয়ে দেখলেন—সায়ান।
তিন বছর পরেও সে আগের মতোই শান্ত, কিন্তু চোখে অন্যরকম দীপ্তি।
সে বলল, “আমি এখন ইউনিভার্সিটিতে বাংলা পড়াই। এসেছি আপনার কাছে একটা বই জমা দিতে।”
নামিরা বইটা হাতে নিলেন—নামের পাশে লেখা,
"চুপচাপ ভালোবাসা: এক গ্রন্থাগারের গল্প"।
লেখক—সায়ান রহমান।
নামিরা ধীরে বইটা খুলে দেখলেন—ভিতরে উৎসর্গে লেখা,
“তাঁকে, যিনি শব্দ ছাড়া ভালোবাসতে শেখালেন।”
নামিরার চোখের কোণে তখন নীরব এক ফোঁটা জল।
সেও ছিল ভালোবাসার মতো—শব্দহীন, কিন্তু সত্যি।