"শেষ বিকেলের আলো"
১
বিকেলটা একটু অন্যরকম। শেষ বিকেলের রোদ মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। গ্রামের পশ্চিম পাড়ে, বড় বটগাছের ছায়ায় বসে আছে তামান্না। মাথায় ওড়না, হাতে পুরনো একটি বই—নির্মলেন্দু গুণের কবিতা। ওর সামনে পাটখেতে হালকা বাতাসে দুলছে পাতাগুলো। সময়টা যেন থেমে গেছে এখানে।
তামান্না এই গ্রামে নতুন না, কিন্তু মাঝখানে ছয় বছর ছিল ঢাকায়—মাস্টার্স করেছে বাংলা সাহিত্যে। এখন আবার ফিরেছে—চাকরি হয়নি, শহরের কোলাহল ওর ভালো লাগেনি।
এখন সে সময় কাটায় বই পড়ে, প্রকৃতিকে দেখে, আর ভাবনায় ডুবে থাকে।
এই বিকেলটাও তেমন এক ভাবনার সময়—কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম। কারো পায়ের শব্দে তামান্না পেছন ফিরে তাকায়।
আদনান—যে কিনা ছেলেবেলার খেলার সাথী ছিল, এখন এ গ্রামেরই স্কুলের শিক্ষক। অনেক বদলে গেছে ছেলেটা, চোখে পরিণতির ছাপ, মুখে স্থিরতা।
“চিনতে পারছিস?” — মুচকি হেসে বলে আদনান।
তামান্না হেসে মাথা নেড়ে, “চেনা চেহারা... তবে আগের মতন পাগলাটে না!”
আদনান মাটিতে বসে পড়ে। “পাগলাটে সময় পেছনে ফেলে এলাম। এখন শুধু দৃষ্টিটা তোর দিকে আটকে থাকে। তোর মতো মানুষকে কাছ থেকে না দেখে উপায় কী!”
তামান্না একটু অপ্রস্তুত হয়, মুখে কিছু বলে না। বাতাসে তার ওড়না উড়ছে ধীরে ধীরে।
২
পরের কয়েকদিন তামান্না আর আদনান প্রায় প্রতিদিন বিকেলে দেখা করে—কখনো নদীর ঘাটে, কখনো আমবাগানে। তাদের মধ্যে পুরনো বন্ধুত্ব ফিরে আসে, আবার তৈরি হয় নতুন কিছু অনুভব।
একদিন আদনান হঠাৎ বলে বসে,
“তুই গ্রামে থেকে যাবি?”
তামান্না একটু চুপ করে বলে, “চাকরি না পেলে এখানেই হয়তো থাকব। তবে মনটা কোথাও যেন থেমে গেছে, জানিস?”
“যেখানে থেমে গেছে, সেখানেই তো শুরু হতে পারে নতুন গল্প।”
তামান্না হেসে ফেলে। “তুই এখন কথায় কথায় কবিতা বলে। ছেলেবেলার মতন মারামারি কই গেল?”
আদনান বলে, “মনের ভেতর যুদ্ধ এখনও চলে... শুধু শব্দগুলো নরম হয়ে গেছে।”
৩
একদিন সন্ধ্যার আগে। হঠাৎ বৃষ্টি নামে। দুজন তখন ছিল স্কুলের পাশে বটতলায়। আশপাশে কেউ নেই। গা ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু ওরা হাটছে ধীরে ধীরে।
বৃষ্টির মাঝে আদনান বলল, “তুই কি কখনো বুঝেছিস, আমি তোকে ভালোবাসি?”
তামান্নার পা থেমে গেল। সে তাকাল আদনানের চোখে। সেগুলো তখন নীরব, ভেজা, কিন্তু দৃঢ়।
“তোর ভালোবাসা যেমন চুপচাপ ছিল, আমিও বুঝেছি… কিন্তু সাহস হয়নি কিছু বলার।”
“এখন?”
তামান্না মাথা নিচু করে বলল, “এখন শুধু চাও—আমি থাকি পাশে। বাকিটা সময় বলে দিক।”
সেই বৃষ্টিতে, শেষ বিকেলের আলোয়, দুইটা মন এক হলো—শব্দ ছাড়া।
৪
দুই মাস পর। তামান্না ঢাকায় একটা কলেজে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে গেল। চলে যেতে হলো। তবে আদনান জানত, এই ভালোবাসা দূরত্বে হারায় না।
তামান্না যাওয়ার দিন নদীর ঘাটে আদনান চুপচাপ একটা চিঠি দেয়।
চিঠিতে লেখা—
“শেষ বিকেলের সেই আলোতে আমি তোকে দেখেছিলাম অন্যরকম হয়ে উঠতে। তুই যেমন ছুঁয়ে গেছিস আমার নীরব দিনগুলো—তুই থাকিস দূরে হলেও, তোর আলোয় আমি বেঁচে থাকব প্রতিদিন।”
তামান্নার চোখে জল আসে। গাড়ির জানালার পাশে বসে সে জানালা দিয়ে দেখে শেষবারের মতো গ্রামের গাছপালা, পুকুর, নদী… আর আদনান।
রোদটা তখন ঠিক শেষ বিকেলের মতো, নরম, আর ভেতরটাকে আলো করে।