"মেঘে ঢাকা চিঠি"
চিঠিগুলো এখন আর আসে না। অথচ এক সময় প্রতিটা শব্দ ছিল অপেক্ষার বাতিঘর।
শামসুর রহমান একদা ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। অবসর নিয়েছেন বছর দুই আগে। বয়স প্রায় ষাট। গ্রামের নাম বাঁশবাগান, পদ্মার কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা গ্রাম। এই গ্রামের সবচেয়ে বড় বইয়ের সংগ্রহ নাকি শামসুর রহমানের ঘরেই।
কিন্তু গ্রামের কেউ জানে না—তার সংগ্রহের সবচেয়ে দামী জিনিসগুলো বই নয়, বরং কিছু পুরনো চিঠি। যেগুলো সে লিখেছিল, কিন্তু কখনো পাঠায়নি।
সেই চিঠিগুলো সব লেখা একজনের জন্য—রোকেয়া।
রোকেয়ার সাথে শামসুরের পরিচয় হয়েছিল শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে। রোকেয়া তখন নতুন নিয়োগ পাওয়া সহকারী শিক্ষিকা। শান্ত, নম্র, আর অন্য সবার চেয়ে আলাদা এক দীপ্তি ছিল তার চোখে।
বছরের পর বছর একসাথে কাজ করেছেন, একসাথে ক্লাস নিয়েছেন, বার্ষিক শিক্ষা সফরে গেছেন। অনেকেই বুঝে গিয়েছিল, ওদের মধ্যে অদ্ভুত এক বন্ধন আছে।
কিন্তু কেউ কখনো কিছু বলেনি, এমনকি তারা নিজেরাও না। সমাজ, পরিবার, দায়িত্ব—সব কিছু চাপা দিয়ে রেখেছিল সেই অনুভূতিগুলোকে।
শামসুর রহমান মাঝেমধ্যে চুপিচুপি চিঠি লিখতেন রোকেয়ার নামে। লিখতেন তার ভালো লাগা, অনুরাগ, বৃষ্টিভেজা বিকেলের অনুভূতি—কিন্তু কখনো পোস্ট করতেন না। চিঠিগুলো থাকত তার আলমারির নিচের একটি টিনের বাক্সে।
একদিন রোকেয়া হঠাৎ করে বদলি হয়ে চলে গেলেন। কোথায় গেলেন কেউ জানে না। ফোনের যুগ তখনো পুরোপুরি আসেনি। শুধু একটা কথাই রটে—রোকেয়ার বিয়ে হয়েছে দূরের কোনো জেলায়।
সেই থেকে প্রতিদিন বিকেলে শামসুর রহমান বারান্দায় বসেন। চায়ের কাপ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে মেঘ করে, মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে।
যেদিন খুব মেঘলা হয়, তিনি একেকটা চিঠি লেখেন—“রোকেয়া, আজ মেঘ জমেছে। তোমার মতোই নীরব।”
এভাবেই কেটে গেছে বছর দশেক। কেউ জানে না, এই বৃদ্ধ শিক্ষক কেন এখনো প্রতিদিন পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে হাঁটেন, কেন মাঝেমধ্যে কাগজে কিছু লেখেন আবার ছিঁড়ে ফেলেন।
একদিন বর্ষার সন্ধ্যায়, হঠাৎ পাড়ার ছোট্ট ছেলেটি—রায়হান—একটা খাম এনে দিল।
“চাচা, পোস্ট মাস্টার সাহেব বলল আপনাকে দিতে।”
শামসুর রহমান অবাক হয়ে খামটা খুললেন।
লেখা:
“শামসুর, আজ প্রথমবার সাহস করলাম। জানি, অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় শুধু তোমার কথা মনে পড়ল। আমি এখনো বেঁচে আছি—একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল। মনে আছে, তুমি বলেছিলে—‘রোকেয়া একদিন বড় হবে’। তুমি সত্যিই জানতে।’”
চিঠির নিচে স্বাক্ষর—রোকেয়া আক্তার।
শামসুর রহমান স্তব্ধ হয়ে গেলেন। হাত কাঁপছে, চোখ ঝাপসা। এত বছর পর, এই চিঠি—এ যেন মেঘের আড়াল থেকে রোকেয়ার হাসি।
পরদিন সকালে, শামসুর রহমান তার টিনের বাক্সটা বের করলেন। চিঠিগুলো আবার পড়তে লাগলেন একে একে। মনে হলো, প্রতিটি অক্ষর আজও জীবন্ত।
তারপর তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিলেন—এই চিঠিগুলো সে এবার পাঠাবে।
পুরনো পোস্টকার্ডে সুন্দর হস্তাক্ষরে সে লিখল:
“রোকেয়া, তুমি সাহস করেছো, এখন আমার পালা। এই চিঠিগুলো তোমার, সব কথা যেগুলো আমি বলতে পারিনি—সব মেঘে ঢাকা ভালোবাসা।”
দুই সপ্তাহ পর, এক দপ্তরী এসে বলল—“স্যার, আপনাকে একজন খুঁজছে। বাইরে একজন ম্যাডাম গাড়ি থেকে নেমেছে।”
শামসুর রহমান বারান্দায় গিয়ে দেখলেন—একজন মাঝবয়সী নারী, চোখে চশমা, হাতে ছাতা, ভেজা শাড়ি।
রোকেয়া।
চোখে জল, মুখে দীর্ঘশ্বাস। কিছু না বলেই তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত।
তারপর রোকেয়া ধীরে বলল, “চিঠিগুলো পেয়ে মনে হলো, আমি সময়ের অনেক ঋণী। তাই এলাম, মেঘের আড়াল ভেদ করে।”
শামসুর রহমান শুধু বললেন, “এতদিন পরও তোমার লেখা চিঠি আমার হৃদয়টাকে ভিজিয়ে দিল, রোকেয়া।”
বৃষ্টি তখন থেমেছে, কিন্তু চারপাশ এখনো ভেজা। পাখিরা ডাকে, বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ।
মেঘে ঢাকা চিঠিগুলোর মতো, তাদের ভালোবাসাও আবার আলো দেখতে পেল।