"নীল চিঠির সন্ধানে"
বছরের শেষ বিকেল। গাছের পাতায় হালকা ঝরঝরে হাওয়া, কুয়াশা গা ছুঁয়ে যাচ্ছে নরমভাবে। ছোট্ট শহর মেঘপুর যেন ঢুকে পড়েছে কোনো ছবির ফ্রেমে—চুপচাপ, শান্ত।
এই শহরের এক কোণায়, ছায়া ঢাকা এক পুরনো দোতলা বাড়ি। দরজার সামনে টিনের বাক্স, আর তার ঠিক ওপরেই বসে আছে তাহসিন—চিঠির ডাক খোলা তার পুরনো অভ্যাস।
তাহসিন একজন শিক্ষক, সাহিত্য নিয়ে পড়ে, কবিতা লেখে। একসময় ঢাকায় ছিল, এখন ফিরে এসেছে নিজের ছোট শহরে। কারণ? তার মায়ের মৃত্যুর পর, এই বাড়িটা একা হয়ে গিয়েছিল। আর একা ঘর খুব বেশি দিন ফাঁকা থাকলে, সে কেবল ‘ঘর’ থাকে না, সে হয়ে যায় একটা অতীত।
তাহসিন ঠিক করেছে—সে অতীতটাকে ছুঁয়ে দেখবে। পুরনো চিঠিগুলো তাই বারবার খুলে পড়ে।
একটা নীল খামে লেখা চিঠি প্রায় সাত বছর আগের। কোনো প্রেরকের নাম নেই। শুধু নিচে লেখা:
"তুই যদি ফিরে আসিস, এই চিঠিটার উত্তর দিস।"
তাহসিন জানে, এই চিঠি এসেছে মুনিয়ার কাছ থেকে।
মুনিয়া—ছোটবেলার বন্ধু, কলেজের সহপাঠী, আর এমন কেউ, যার সঙ্গে ভালোবাসা কখনো বলা হয়নি। তারা একে অন্যকে ভালোবাসতো, কিন্তু মুখে বলেনি কেউ।
তাহসিন ঢাকা চলে যাওয়ার পর যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনকার মোবাইল নম্বর বদলে গেছে, ঠিকানা হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই চিঠিটা থেকে গেছে।
আজ এত বছর পর, সেই চিঠির উত্তর দিতে ইচ্ছা হলো তাহসিনের। সে ডায়েরি খুলে একটা নতুন চিঠি লিখতে শুরু করল।
**“মুনিয়া,
তুই বলেছিলি, আমি যদি ফিরি, তাহলে যেন এই চিঠির উত্তর দিই।
আমি ফিরেছি। কিন্তু তুই নেই।
তুই এখন কোথায়, কী করিস জানি না। তবে আমি আজও সেই নীল চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে থাকি—যেন তুই এই খামের মধ্যে লুকিয়ে আছিস।
আমি তোকে খুঁজতে এসেছি, মুনিয়া।
তুই কি এখনও নীল চিঠি লিখিস?”**
চিঠিটা লেখা হয়ে গেলে, সে একটা পুরনো খামে ভরে রাখল।
কিন্তু পাঠাবে কোথায়?
ঠিক তখন, এক কাক ডেকে উঠল বাড়ির পেছনের বটগাছের ডালে। তাহসিন হেসে বলল, “যদি তুই ডাকে চিঠি পৌঁছে দিতে পারতিস!”
পরদিন সকালে, তাহসিন গেল শহরের পোস্ট অফিসে। সেখানে কাজ করে এক পরিচিত মুখ—রফিক চাচা, প্রায় তিরিশ বছর ধরে পোস্টম্যান।
তাহসিন জিজ্ঞেস করল, “চাচা, আপনি কি মুনিয়া নামের কাউকে চেনেন? আগে চকবাজার এলাকায় থাকত, এখন হয়তো অন্য কোথাও।"
রফিক চাচা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “মুনিয়া? ও কি কলেজে পড়ত, মুখে সব সময় হাসি থাকত?”
তাহসিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “হ্যাঁ! আপনি জানেন?”
“ও এখন হরিপুর স্কুলে শিক্ষকতা করে। বিয়েশাদি করেনি। খুব চুপচাপ থাকে।”
তাহসিন মনে মনে বলল, “সে-ই তো, মুনিয়া কখনো জোরে কিছু বলত না। চুপ করে ভালোবাসতো।”
চিঠিটা সে রফিক চাচার হাতে দিয়ে বলল, “এই চিঠিটা ওর কাছে পৌঁছে দেবেন চাচা?”
রফিক চাচা হাসলেন, “নিশ্চয়ই দেব।”
তিন দিন পর।
বিকেল সাড়ে চারটা। মেঘলা আকাশ, আর একফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠিক তখনই বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
তাহসিন দরজা খুলে দেখল—সামনে দাঁড়িয়ে মুনিয়া।
ছিমছাম শাড়ি, ভিজে চুলের প্রান্ত থেকে ফোঁটা ঝরছে। মুখে একরাশ বিস্ময়।
“তুই সত্যিই ফিরেছিস?”—মুনিয়া জিজ্ঞেস করল।
তাহসিন হেসে বলল, “চিঠির উত্তর দিলাম, বুঝলি না?”
মুনিয়া চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আমি ভেবেছিলাম, তুই আর কখনো ফিরবি না। তুই এত বড় শহরে চলে গেছিস… আমি শুধু অপেক্ষা করতাম।”
তাহসিন শান্ত গলায় বলল, “আমি যতদূরই যাই, এই নীল চিঠিটা আমায় টেনে এনেছে। তুই তো জানিস, আমি শব্দে বসবাস করি। আর তোর লেখা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি শব্দ।”
বৃষ্টির শব্দ বেড়ে গেল। দুজন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ছাতার নিচে নয়, বরং একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে। যেন তাদের ভেতরের চুপচাপ ভালোবাসাটাও অবশেষে শব্দ খুঁজে পেল।
মুনিয়া বলল, “তুই কি আবার চলে যাবি, তাহসিন?”
তাহসিন বলল, “না। এই শহরেই থাকব, যদি তুই থাকিস আমার পাশে। আমরা আবার একসাথে চুপচাপ গল্প লিখব, যেমনটা ছোটবেলায় লিখতাম।”
মুনিয়া মাথা নুইয়ে বলল, “তাহলে একটা নতুন চিঠি লিখি, এবার আমরা দুজনের নামে?”
তাহসিন বলল, “লিখ, এবার যেন প্রেরক ও প্রাপক একই হয়।”
Rainil Hasan Rokon
Удалить комментарий
Вы уверены, что хотите удалить этот комментарий?