"আঁধার ভরা আলো"
মুন্না ছিল একজন অন্ধ ছেলে। চোখে না দেখতে পেলেও সে দেখতে পেত হৃদয় দিয়ে। সে জানত—রঙ কেমন, আলো কেমন, বৃষ্টি কেমন। ছোটবেলায় এক দুর্ঘটনায় তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়, কিন্তু তার মন কখনো অন্ধ হয়নি।
সে থাকত পাহাড়পুর নামের এক গ্রামে। পাহাড়পুর ছোট্ট গ্রাম, সবুজে মোড়া, পাখির কাকলিতে ভরা। মুন্নার মা রোকেয়া খাতুন গ্রামের স্কুলে রান্নার কাজ করতেন। মুন্না প্রতিদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে যেত। কেউ তাকে আলাদা চোখে দেখত না। বরং সবাই ভালোবাসত।
কিন্তু একদিন, স্কুলে এল এক নতুন মেয়ে। নাম ফাইজা। বাবার বদলির চাকরির কারণে এসেছে এই গ্রামে। শহরের মেয়েটা শুরুতে গ্রামকে বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে ভালোলাগা জন্ম নেয়—সবুজ, স্নিগ্ধ জীবনধারার।
মুন্নার সাথে তার প্রথম দেখা স্কুল লাইব্রেরির বারান্দায়। মুন্না সেদিন হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেল। ফাইজা এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরল।
“তুমি চোখে দেখতে পাও না?” ফাইজা বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল।
মুন্না শান্তভাবে বলল, “না। কিন্তু আমি বুঝি কে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। তুমি নতুন এসেছো, তাই না?”
ফাইজা অবাক, “তুমি জানলে কীভাবে?”
মুন্না বলল, “তোমার গন্ধ অন্যরকম। শহরের মেয়েরা অন্য রকম সুগন্ধি ব্যবহার করে।”
সেই দিন থেকেই শুরু তাদের এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব। ফাইজা প্রতিদিন মুন্নার পাশে বসত। গল্প করত, কবিতা পড়ত, বৃষ্টির শব্দ শুনত একসাথে।
একদিন ফাইজা জিজ্ঞেস করল, “তুমি যদি চোখে দেখতে পেতে, কী সবচেয়ে আগে দেখতে চাইতে?”
মুন্না কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার মুখ।”
ফাইজার গাল লাল হয়ে গেল, কিন্তু সে কিছু বলল না।
মুন্না মাঝে মাঝে বলত, “তুমি জানো, আমি কেমন করে তোমাকে দেখি?”
“কেমন করে?”
“তোমার কথা শুনে আমি তোমার মুখ আঁকি মনের ভেতর। তোমার হেসে ওঠা শব্দে বুঝি তুমি কেমন। তোমার নীরবতায় বুঝি তুমি কাঁদছো।”
বছর ঘুরে গেল। একদিন খবর এলো—ফাইজার বাবা আবার বদলি হচ্ছেন। এবার অনেক দূরে, যাওয়া মানেই আর কখনও না ফেরা।
সেদিন স্কুলের শেষে ফাইজা বলল, “তুমি জানো, আমি হয়তো আর আসব না।”
মুন্না চুপ করে রইল। শুধু বলল, “তুমি কি একবার আমাকে ছুঁয়ে দেখতে দেবে? যেন মনে রাখতে পারি তোমার উপস্থিতি।”
ফাইজা ধীরে তার হাত রাখল মুন্নার হাতে। নীরব মুহূর্ত। মুন্নার মুখে এক ধরনের আলো ফুটল—আঁধারের মধ্যেও একরকম আলো।
ফাইজা চলে গেল।
ছয় বছর পর।
মুন্না এখন গ্রামে বসেই ছোট একটি প্রতিবন্ধী স্কুল চালায়। নিজের মতো করে সে বাচ্চাদের শেখায়—আলো কেবল চোখ দিয়ে নয়, মন দিয়ে দেখা যায়।
একদিন খবর এলো—ঢাকা থেকে একজন সাংবাদিক আসছে ওর সাক্ষাৎ নিতে। মুন্না অবাক। তার মতো একজন অন্ধ গ্রামের ছেলের খবর কিভাবে শহরে পৌঁছালো?
সাংবাদিক এলো বিকেলে। গাড়ি থেকে নামল এক নারীবিশেষ। মাথায় সাদা স্কার্ফ, চোখে সানগ্লাস।
মুন্না অনুভব করল—চেনা গন্ধ।
“তুমি কি ফাইজা?” ধীরে জিজ্ঞেস করল সে।
মেয়েটা সানগ্লাস খুলে বলল, “হ্যাঁ মুন্না, আমি ফিরেছি। আমি চাই, পুরো দেশ জানুক—তুমি কেমন করে আলো দেখো।”
মুন্নার চোখে তখনও অন্ধকার, কিন্তু মুখজুড়ে সেই আলো, যা বিশ্বাস, প্রেম আর অপেক্ষার ছায়া।
Rainil Hasan Rokon
टिप्पणी हटाएं
क्या आप वाकई इस टिप्पणी को हटाना चाहते हैं?