"ফিরে দেখা সেই দিনগুলো"
দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেছে। সময় বড়ই নিষ্ঠুর—আমাদের ভালোবাসা, অভিমান, অপেক্ষা—সবকিছু সময়ের স্রোতে ভেসে যায়। কিন্তু কিছু কিছু দিন, কিছু কিছু সন্ধ্যা, কিছু কিছু হাসি—মন থেকে মুছে যায় না।

নাবিলা এখন দেশের বাইরে থাকে, মালয়েশিয়ায়। বড় কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে, ব্যস্ততা তাকে গ্রাস করে রেখেছে। কিন্তু আজ তার মন হঠাৎ করেই ফিরে গেছে সেই পুরনো শহরে, রংপুরের ছোট্ট পাড়ায়।

সেই শহরে, যেখানে সে প্রথমবার কারও জন্য অপেক্ষা করেছিল। প্রথমবার ভালোবাসা বুঝেছিল। আর প্রথমবার হারিয়েছিলও।

তার নাম ছিল রাইহান।

দশ বছর আগে...

নাবিলা তখন কলেজে পড়ে। ইংরেজি সাহিত্যে আগ্রহ, কবিতা মুখস্থ বলতে পারত, রবীন্দ্রনাথ তার হৃদয়ের ভাষা। আর রাইহান ছিল পুরো বিপরীত—গণিতে পারদর্শী, বাস্তববাদী, কিন্তু চোখে ছিল একরাশ স্বপ্ন।

তাদের প্রথম দেখা শহরের লাইব্রেরিতে। নাবিলা তখন শেক্সপিয়রের বই খুঁজছিল। আর রাইহান ভুল করে তার হাতে দিয়েছিল নিউটনের থিওরির বই।

“উম... এটা তো আমি খুঁজছিলাম না,” বলেছিল নাবিলা।

রাইহান হেসেছিল। “তবে আপনি যা খুঁজছেন, সেটা হয়তো জীবনের অন্য কোন খাতে অপেক্ষা করছে।”

সেই দিন থেকে শুরু। দুজনের দেখা হতে লাগল লাইব্রেরিতে, রাস্তায়, চায়ের দোকানে। বন্ধুত্ব গভীর হলো, তারপর একরকম না বলা ভালোবাসায় রূপ নিল।

নাবিলা জানত, রাইহান তাকে ভালোবাসে। রাইহান জানত, নাবিলা তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

কিন্তু কেউ বলেনি কিছু।

তাদের সম্পর্ক ছিল ঠিক যেন জুন মাসের বৃষ্টি—আসে হঠাৎ, শান্ত করে দেয়, আবার হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায়।

একদিন সন্ধ্যায়, বৃষ্টি পড়ছিল খুব। রাইহান হঠাৎ বলেছিল, “চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”

নাবিলা অবাক হলেও রাজি হয়েছিল। দুজনে গিয়েছিল শহরের বাইরের এক ছোট্ট নদীর পাড়ে। পাড়ে বসে রাইহান বলেছিল:

“তুই জানিস, মানুষ চাইলেও সবসময় যাকে চায়, তার কাছে থাকতে পারে না।”
নাবিলা কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, “আমি তোর কাছে থাকতেই চাই।”

কিন্তু জীবন এত সহজ নয়।

পরের সপ্তাহেই রাইহান জানায়, সে বিদেশে স্কলারশিপ পেয়েছে। পড়তে যাবে কানাডা।

নাবিলা তখন অনেক বলেছিল—“থেকে যা। আমরা একসাথে লড়তে পারি।”

কিন্তু রাইহান হেসে বলেছিল, “তুই অনেক বড় হবি। আমি যদি তোকে ভালোবাসি, তবে তোকে আটকে রাখতে পারি না।”

সেই বিদায়ের দিন, নাবিলা কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল, “যদি কখনো ফিরে আসিস, এই নদীর পাড়ে আমাকে খুঁজে পাবি।”

রাইহান মাথা নেড়েছিল। তারপর প্লেন চড়েছিল—চিরতরে।

বর্তমানে...

নাবিলা ছুটিতে দেশে এসেছে। সময় কাটাতে এসে হঠাৎ একদিন পা চলে যায় সেই পুরনো নদীর পাড়ে।

বৃষ্টি পড়ছে। ঠিক সেই দিনের মতো। আকাশে মেঘ, বাতাসে শূন্যতা। সে চুপ করে বসে থাকে।

তখনই হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে—
“তুই ঠিক বলেছিলি। তোকে এখানে পাওয়া যাবে।”

নাবিলা ঘুরে তাকায়। চোখ বড় হয়ে যায়।

রাইহান।

একটু বদলে গেছে—চোখে চশমা, মুখে পরিণতির ছাপ, কিন্তু হাসিটা ঠিক আগের মতোই।

“তুই... তুই ফিরে এসেছিস?”

রাইহান মাথা নাড়ে, “চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। এই শহরের কথা, তোদের কথা ভুলতে পারিনি। বিশেষ করে তোকে না।”

নাবিলা চুপ করে থাকে। চোখে জল। বৃষ্টি ফোঁটার সাথে মিশে যায় যেন।

রাইহান ধীরে এসে বসে পাশে। “তোকে এখনো ভালোবাসি, নাবিলা। এতগুলো বছর—তুই ছাড়া কেউ জায়গা নিতে পারেনি।”

নাবিলা বলে, “আমি কখনো চেয়েও অন্য কারো দিকে তাকাইনি। জানতাম, তুই ফিরবি।”

তাদের দুজনের মাঝে তখন আর কোনো দূরত্ব ছিল না—না শব্দে, না মনে। বৃষ্টি থেমে যায়, মেঘ সরে গিয়ে রোদের আলো পড়ে নদীর জলে।

কখনো কখনো, ফিরে আসা মানেই নতুন করে শুরু।