শেষ বিকেলের সে মেয়েটি
রাজশাহীর রেলস্টেশন তখন একেবারে নীরব হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নামার আগের সেই সময়টা সবসময় একটু অন্যরকম লাগে কাফির কাছে—অস্পষ্ট আলো, ভেজা বাতাস আর ছায়া হয়ে যাওয়া মানুষদের মুখ। এমন এক বিকেলে সে প্রথম দেখে আনুশকাকে।
আনুশকা বসে ছিল একটি পুরনো বেঞ্চে, পাশে একটি বড় স্যুটকেস। কাফি তখন সবে বন্ধু রাহাতকে বিদায় দিয়ে ফিরছিল। অচেনা সেই মেয়েটির চোখে কিছু একটা ছিল—বিস্ময়? অভিমান? না হয়তো এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, যেটা কাফির চেনা।
কাফি দূর থেকে তাকিয়েই থাকলো কিছু সময়। আনুশকার মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু চোখে পানি জমেছে। একটু পর হঠাৎ করেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয় কাফির। আনুশকা নিচু স্বরে বলে,
“এই শহরে কেউ নেই আমার। অথচ আমায় এই শহরেই থাকতে হবে…”
একটা অসহায়তা ছিল সেই কণ্ঠে, আর সেটাই কাফির ভেতরে একটা কিছু নড়িয়ে দেয়। তার সাহস হয়, সে পাশে গিয়ে বসে।
“আমি কাফি,” সে বলে।
“জানি না কেন, কিন্তু মনে হলো—তোমার পাশে গিয়ে বসাটা ঠিক হবে।”
আনুশকা মাথা নেড়ে শুধু বলল, “আমি আনুশকা। ঢাকার মেয়ে। আমার মা নেই। ফুপুর কাছে এসেছি, কিন্তু তিনি এখনো বাড়ি ফেরেননি। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় লাগছে।”
সন্ধ্যা নামছে, বাতি জ্বলছে চারপাশে। কাফি আনুশকাকে জিজ্ঞেস করল, “চলো, আমি তোমায় তোমার ফুপুর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসি। দরকার হলে ফোন করে ডেকে দিই।”
প্রথমে দ্বিধা করলেও পরে রাজি হয় আনুশকা। তারা দু’জনে রিকশায় চড়ে বসে, বাতাসে এক ধরনের অচেনা নীরবতা ভাসে।
সেই দিনের পর কাফি আর আনুশকার দেখা হওয়া শুরু হয় নিয়মিত। প্রথমে আনুশকার অনিচ্ছা থাকলেও, ধীরে ধীরে সেই মেয়েটা মিশে যেতে থাকে কাফির জীবনে। গল্প, আড্ডা, হাঁটাহাঁটি—সবকিছুতে তাদের একটা ছায়া জমে।
একদিন হঠাৎ করে কাফি জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি কখনো মনে হয়, তুমি আর আমি একটু বেশিই জড়িয়ে গেছি?”
আনুশকা হাসলো। বলল, “মনে হয় প্রতিদিনই। কিন্তু ভয় পাই… সম্পর্ক শব্দটার ওজন অনেক বড়।”
কাফি তখন বলেছিল, “ভালোবাসার জন্য সাহস লাগে। ভয় নয়।”
আনুশকা চুপ করে গিয়েছিল।
এরপরের কিছুদিন খুব ভালো যায়। কিন্তু একটা সময় জানা যায়, আনুশকার ফুপু চায় না সে কাফির সঙ্গে মিশুক। কারণ কাফির সামাজিক অবস্থান তেমন ভালো না। পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চাকরির খোঁজে দিন পার করে সে।
একদিন আনুশকা বলে, “আমরা কি থেমে যাই কাফি?”
কাফি অবাক হয়ে বলে, “তুমি কি চাও থেমে যেতে?”
আনুশকা চোখের কোণে পানি নিয়ে বলল, “আমি চাই না, কিন্তু হয়তো এই চাওয়াটাই বাস্তব না।”
তারপর আর দেখা হয়নি তাদের।
অনেক বছর পর, কাফি যখন একটা ছোট চাকরিতে ঢুকে স্থির জীবন গড়ে ফেলে, তখন একদিন রাস্তার মোড়ে দেখা হয় আনুশকার সঙ্গে।
সে এখন একজন শিক্ষক। চোখে সেই পুরনো ঝিলিক, কিন্তু মুখে পরিণতির ছাপ।
দুজনেই দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। কোনো কথা হয়নি।
চলে যাওয়ার আগে শুধু কাফি বলেছিল,
“শেষ বিকেলে যেমন করে তুমি এসেছিলে, ঠিক তেমন করেই চলে গেলে।”
আনুশকা শুধু একটুকরো হাসি ফেলে বলেছিল,
“কিছু কিছু গল্প পূর্ণতা পায় না কাফি… ওরাই বেঁচে থাকে সবচেয়ে বেশি দিন।”